প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট চায় নির্বাচন কমিশন

Untitled-56-5e011ea3df1ab

রাজধানী ঢাকার দুই (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনের ভোটাভুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের মতে, রাজনৈতিক দল ও জনগণ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে অংশ নিলে ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন করা সম্ভব। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি ছাড়াও বিএনপি দুই সিটির মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে বলে আশা করছে ইসি। তবে তফসিল ঘোষণার পরেও কিছু আইনি জটিলতার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

বিশ্নেষকদের মতে, বর্তমান ইসির অতীত কার্যক্রমে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জনগণ তাদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাই ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতিও কমে আসছে। সাংবিধানিক এই সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন ছাড়া গুণগত পরিবর্তন আসবে না। তবে নিকট অতীতের নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি কমে যাওয়ার দায় রাজনৈতিক দলগুলোকেই দিচ্ছে ইসি।

গত রোববার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে তফসিল ঘোষণাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ভোটারদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে ইসি নিরপেক্ষ আচরণ করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দল ও জনগণের স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশগ্রহণ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিও এ নির্বাচনে অংশ নেবে।

সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও তাদের জোট ইসির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করলেও এ নির্বাচনে তারা অংশ নিতে চলেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জোট শরিক ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো জানিয়েছে, এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে- তা বিবেচনায় নিয়েই তারা দুই সিটির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও জানিয়েছেন, জয়-পরাজয় যা-ই হোক; এ নির্বাচনে সর্বোচ্চ সামর্থ্য  দিয়েই মাঠে থাকবেন তারা।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর অতীতে তাদের ভূমিকায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস মানায় না। এ ধরনের আশ্বাস দেওয়া জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের ভোটসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও চিহ্নিত আমলাদের সঙ্গে ইসি আঁতাত করে জনগণের আস্থা হারিয়েছে। সিইসিসহ কমিশনারদের পদত্যাগ বা অপসারণ করে পুনর্গঠনের মাধ্যমেই দেশের ভোট পরিস্থিতির গুণগত মান উন্নয়ন সম্ভব।

একই ধরনের মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির কর্মকাণ্ড জাতির জন্য বিব্রতকর। টিআইবিপ্রধান তাদের অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, ইসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে। সবশেষে তারা নিজেদের মধ্যে সচিবালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বন্দ্বেও জড়িয়েছে। এ কমিশন বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

আইনের আশ্রয় নেবেন বর্ধিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা :এদিকে ইসির পক্ষ থেকে তফসিল ঘোষণা করা হলেও আইনি জটিলতায় অতীতের মতো আবারও নির্বাচন আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বর্ধিত অংশের নির্বাচনে বিজয়ী ওয়ার্ড কাউন্সিলররা মনে করছেন, তারা নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচ বছরের জন্য। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে উপনির্বাচনের সঙ্গে বর্ধিত ৩৬টি ওয়ার্ডের নির্বাচন হয়। ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটার সংখ্যা নিয়েও আপত্তি রয়েছে তাদের। কারণ ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন হলেও সাধারণ ওয়ার্ডের সংখ্যা ৫৪টি এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮টি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ভোটার সংখ্যা ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৮ জন হলেও সাধারণ ওয়ার্ডের সংখ্যা ৭৫টি এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড ২৫টি। তাই করপোরেশন থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক বরাদ্দ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির বর্ধিত এলাকার ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুর রহমান শফিক বলেন, ফেব্রুয়ারিতে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তার পর থেকে এই ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ পাননি। দুই কোটি টাকার কাজের একটি টেন্ডার হয়েছে। কিন্তু কাজ এখনও শুরু হয়নি। গত তিন মাস ধরে ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার ও ঝাড়ূ দেওয়ার জন্য ২৫ জন এবং মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য ১০ জন কর্মী দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কাউন্সিলরদের মধ্যে অনেকেই তার সঙ্গে মামলার প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেছেন। তবে তিনি নিজে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হননি বলে দাবি করেন।

বর্ধিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে দুই সিটির বর্ধিত এলাকার ৩৬ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয় সরকার থেকে স্পষ্ট করা হয়নি- তারা উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র ৯ মাসের মাথায় তাদের আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আদালতে গেলে তাদের দাবির পক্ষে রায় আসতে পারে বলে ধারণা করছেন ড. বদিউল আলম।

তবে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, আইনানুযায়ী তারা করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিনের আগের সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছেন। তাই তারা তফসিল দিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তি কখন নির্বাচিত হয়েছেন, সেটা দেখার বিষয় নয়। দেখতে হবে করপোরেশন কখন গঠন করা হয়েছে। তাই আইনি জটিলতার কোনো আশঙ্কা করছেন না তিনি।

ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটারের তারতম্য :ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটার তালিকা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১২৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টি ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে। ৩১টির ভোটারসংখ্যা ৫০ হাজারের ওপরে। পাঁচটি ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। উত্তর সিটির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৯ হাজার ৪২৫। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৫ হাজার ৮৮৯। ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৪৪৮। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৬০। ৩০ নম্বরের পাশের ওয়ার্ড ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা আবার প্রায় অর্ধেক। পাশাপাশি দুটি ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যার ব্যাপক ব্যবধান।

অন্যদিকে উত্তর সিটির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার ১২ হাজার ২২৬ জন এবং ৪৪ নং ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ১৬ হাজার। দক্ষিণ সিটির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার ১২ হাজার ২০৮। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ভেটার ১৫ হাজার ৮৭০। ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার ১২ হাজার ৭৫৪। ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার ১৫ হাজার ৮৩৭ জন।

ইসিসংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, আইনানুযায়ী সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের দায় ইসির হলেও ওয়ার্ডের সীমানা বিন্যাসের কাজ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। তাই কোন ওয়ার্ডে জনসংখ্যা কম আর বেশি, তা ভোটের ক্ষেত্রে ইসির বিবেচ্য বিষয় নয়।

সিটি করপোরেশন আইনানুযায়ী, করপোরেশন গঠনের পর প্রথম সভার দিন থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণের আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়। ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোট হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল এবং প্রথম সভার মাধ্যমে করপোরেশনের যাত্রা শুরু করে ওই বছরের ১৪ মে। একই দিনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ভোট হলেও প্রথম সভার মাধ্যমে করপোরেশনের যাত্রা শুরু হয় ওই বছরের ১৭ মে। তাই চলতি বছরের ১৪ নভেম্বরের পরে ঢাকা উত্তর সিটি এবং ১৮ নভেম্বরের পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের উপযোগী হয়েছে। বর্তমান মেয়ররা পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিলেও এই চলমান করপোরেশন বহাল থাকবে। দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নবনির্বাচিতদের উত্তর সিটিতে ২০২০ সালের ১৩ মে পর্যন্ত এবং দক্ষিণ সিটিতে ১৬ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

Pin It