বাদ পড়ছে ৮৬ লাখ গরিব মানুষ

image-690428-1687808513

মূল্যস্ফীতির কষাঘাত না কমলেও সরকারের সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সহায়তা ও কর্মসংস্থান কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ছেন ৮৬ লাখ গরিব মানুষ। সবচেয়ে বেশি বাদ দেওয়া হয়েছে ভিজিএফ কর্মসূচি থেকে। দ্বিতীয় কাটছাঁট হয়েছে ওএমএস কর্মসূচি। সুবিধাভোগী কমানোর তালিকায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিও আছে। উপকারভোগী বাদ দেওয়ায় এই তিন খাতে আর্থিক বরাদ্দও কমছে চলতি অর্থবছরের চেয়ে এক হাজার আট কোটি টাকা। নতুন তালিকার সুবিধাভোগীদের কার্যক্রম শুরু হবে পহেলা জুলাই থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

উপকারভোগী কমানোর ফলে দুস্থ ও গরিব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মহীন মানুষের মধ্যে খাদ্য সহায়তা নিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, জমি নেই, ভিটাবাড়ি নেই, দিনমজুর, উপার্জনশীলহীন ব্যক্তি পরিবার, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার ও নিম্ন আয়ের মানুষ এসব কর্মসূচির ওপর বেশি নির্ভরশীল।

খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা কমলেও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ওএমএস কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা কমানো হয়নি বরং বাড়ানো হয়েছে। কারণ টিসিবির পণ্য এক কোটি পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চলতি অর্থবছরে শুরুতে ওএমএস কর্মসূচিতে চাল বরাদ্দ ছিল দেড় লাখ টন। বর্তমান সেটি সাড়ে ৬ লাখ টন বিতরণ করতে হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি বলেন, প্রত্যাশার জায়গা থেকে সরকার এসব কর্মসূচির আওতা কমাতে পারে। গত বছর করোনার প্রকোপ বেশি ছিল, আগামীতে সেটি থাকবে না। ফলে যাদের এ কর্মসূচির সুবিধা প্রয়োজন সে সংখ্যা কমে আসবে এমনটি ধারণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হবে কিনা বলা খুব কঠিন। যেহেতু মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। আর সে কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে এখন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা ৪ কোটি ৪৫ লাখ থেকে কমিয়ে ৩ কোটি ৬৭ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ওএমএস কর্মসূচিতে কমানো হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার জন, ভিজিএফ কর্মসূচিতে ৭৭ লাখ এবং অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে কমছে ৭৯ হাজার জন। এই তিন খাতের মধ্যে নতুন অর্থবছরে ভিজিএফ কর্মসূচিতে কমছে আর্থিক বরাদ্দ ৪৫২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ১৫৪২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে আগামী অর্থবছরে এ কর্মসূচিতে ১০৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ওএমএস কর্মসূচি ২ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২ হাজার ১১০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে বরাদ্দ কমছে ২৮৮ কোটি টাকা। আর আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচিতে ২১০৭ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে আগামী অর্থবছরে ১৭৮০ কোটি টাকা রাখা হয়। এতে আর্থিক বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা।

খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি কমানোর পেছনে কোনো যৌক্তিকতা কেউ বলতে পারেনি। যদিও বলা হচ্ছে টিসিবির কার্যক্রম চলার কারণে এটি কমতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য বিতরণ কর্মসূচি চলমান আছে এবং আগামী অর্থছরেও তা অব্যাহত থাকবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু টিসিবির পাশাপাশি এ অর্থবছরে ওএমএস’র আওতায় খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে ৪৫ লাখ ৯০ হাজার জনের মধ্যে। অথচ আগামী অর্থবছরে এই কর্মসূচির সংখ্যা ৪৫ লাখ ৯০ থেকে ৩৭ লাখ ৩৫ হাজার নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এই তালিকা থেকে বাদ পড়া উপকারভোগীদের অনেকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ রেকর্ড বিরাজ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির তথ্যে দেখা গেছে, মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এই হার গত প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো ওএমএস’র ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সে পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি অর্থবছরে ওএমএস উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৭ লাখ ৩৫ হাজার জন থেকে ৪৫ লাখ ৯০ হাজার জনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগামীতে মূল্যস্ফীতি দ্রুত সহনীয় মাত্রায় আসবে এমন কোনো পূর্বাভাস নেই। ফলে এসব বাদ পড়া মানুষগুলো আরও বেশি মাত্রায় দুর্ভোগে পড়তে পারে। বর্তমান একজন ওএমএস কার্ডধারীকে মাথাপিছু সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটা দেওয়া হচ্ছে। প্রতি কেজি চালের মূল্য ৩০ টাকা এবং আটা (২ কেজির প্যাকেট) ৫৫ টাকা।

খাদ্য নিরাপত্তার আরও একটি কর্মসূচি ভিজিএফ। এই কর্মসূচির আওতায় যে পরিবারের সদস্যরা বছরের অধিকাংশ সময় দুবেলা খাবার ঠিকমতো পায় না, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে চরম অর্থ সংকটে পড়েছেন তারা রয়েছেন। এছাড়া পরিবারের প্রধান অসচ্ছল ও অক্ষম প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা, পরিবারে উপর্জনশীল ব্যক্তি নেই, ভিক্ষা ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল, দিনমজুর, জমি ও ভিটাহীন ব্যক্তিদের সুবিধা দেওয়া হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বাজেটের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই কর্মসূচির আওতায় ২ কোটি ৫৭ লাখ উপকারভোগী থেকে কমিয়ে আগামী অর্থবছরে এক কোটি ৮০ লাখে নামানো হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা কমছে ৭৭ লাখ।

সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার অন্যান্য কর্মূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ও আর্থিক বরাদ্দ ঠিক রাখা হয়েছে। এরমধ্যে উপকারভোগীর সংখ্যা জিআর (খাদ্য) ৩৩ লাখ জন, খাদ্য সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম) ৭ লাখ ৪০ হাজার জন, কাজের বিনিময় খাদ্য (কাবিখা) ৯ লাখ ৮০ হাজার জনকে দেওয়া হবে। এছাড়া কাজের বিনিময় টাকা (কাবিটা) ১৮ লাখ ২০ হাজার জন, টিআর (নগদ) ৩ লাখ ৬৯ হাজার জন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ৬২ লাখ ৫০ হাজার জন উপকারভোগীকে দেওয়া হবে।

Pin It