বিজয়ের ৫০ বছর: পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়

image-498596-1639602332

‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে/জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’ শত শত বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে কবির দৃপ্ত পঙ্ক্তির মতো বিজয়ের নিশানে স্বাধীনতা এসেছিল বাঙালির জীবনে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতায় ৩০ লাখ শহিদের তাজা প্রাণ, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের দামামা শেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশে বিজয় এসেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই বিজয়ের পথ ধরে শত বাধা অতিক্রম করে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আজকের বাংলাদেশ।

রাজনৈতিক নানা পটপরিবর্তন, বৈশ্বিক সব বৈরিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আস্ফালন, সামাজিক-অর্থনৈতিক সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিজয়ের ৫০তম গৌরবের দিন আজ। জাতির জীবনে এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলা সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা স্মরণে রেখে সব অর্জন, প্রাপ্তি উদযাপনের দিন।

দিবসটি প্রত্যেক বাংলাদেশির জীবনে এক অনন্য প্রাপ্তি। তাই আজ কবি সুকান্তের কণ্ঠের ধ্বনিতে প্রতিটি বাংলাদেশি আরও একবার উচ্চারণ করবে-‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/অবাক তাকিয়ে রয়ঃ/জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে উদযাপন করা হচ্ছে বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি। দিবসটি উপলক্ষ্যে দেশের মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছে।

সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলোকে জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন বাহিনীর বাদক দল বাদ্য বাজাবেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। এছাড়া ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে যোগ দিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ইতোমধ্যে ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে এটি তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। আজ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের রাষ্ট্রপতি ‘গেস্ট অব অনার’ হিসাবে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।

বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের সাউথ প্লাজায় জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। বিজয়ের আবেগ ও আনন্দ উদযাপনের জন্য আয়োজিত ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।

ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটি টি-৫৫ ট্যাঙ্ক এবং একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের জন্য উপহার হিসাবে প্রদান করবেন।

বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। নিন্দুকদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ মন্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৫০ বছরেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে। যেখানে এখন মাথাপিছু আয় প্রায় ২৫৫৪ ডলার। এই মুহূর্তে সামাজিক ও অর্থনীতির বেশকিছু সূচকে বিশ্বে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশ।

দারিদ্র্য বিমোচন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, মধ্যম আয়ের দেশসহ পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেলসহ ভৌত কাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের বিশেষ অর্জন রয়েছে। পাকিস্তানকে তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুপ্রতিম ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের সংসদে আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে কথা হয়। তারা স্বপ্ন দেখে একদিন বাংলাদেশের মতো উন্নতি করবে। পোশাকশিল্পের অগ্রগতি, দারিদ্র্য নিরসন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলেই পাকিস্তান ও ভারতকে ছাড়িয়ে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) উন্নয়ন সম্মেলন ২০২১-এ এক প্রতিবেদনে বলে, মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ভারতের কাছাকাছি গেছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে বাড়ত অথচ এখন (২০১০ সালের হিসাব) এটা ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ হারে বাড়ছে।

১৯৯০ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় ৩ দশমিক ২৬ হারে বাড়ত, এখন কমে ১ দশমিক ১৪ হার হয়েছে। একইভাবে নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, এটা এখন আরও কমে শূন্য দশমিক ৮৬ হয়েছে। অথচ মাথাপিছু আয়ে নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ।

এখন পাকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু আয়ে ১০ শতাংশ এগিয়ে বাংলাদেশ। উৎপাদন খাতেও ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নব্বইয়ের দশকে এ খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা এখন ১৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

অথচ উৎপাদন খাতে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান। একই সময়ে ভারতে উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ, অথচ এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। একইভাবে উৎপাদন খাতে পিছিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানও।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিছুটা দেরিতে হলেও বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা এখন আর শুধু স্বপ্ন নয়, অনেকটাই বাস্তব। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে ইতোমধ্যে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশকে পেছনে ফেলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখন ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সেই সময় ৪০ শতাংশ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। কিন্তু খাদ্য আমদানি করতে হয় না। শিল্প খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পোশাকশিল্পে চীনের পরেই এখন বাংলাদেশের অবস্থান।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয় করেছে লাল-সবুজের সোনার বাংলা। ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসাবে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন, যা যোগাযোগমাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে চালু হয়েছে সর্বাধুনিক ফাইভজি টেকনোলজি। রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নের পথে এক দুর্বার গতিতে চলছে দেশ।

ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের অমীমাংসিত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করে সমাধান করা হয়েছে ছিটমহল সমস্যার। সমুদ্রসীমায় যুক্ত হয়েছে আরেক বাংলাদেশ। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি জনমনে স্বস্তি দিয়েছে। এসেছে বিশ্ব শান্তিতে নোবেল। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছে দিতে নেওয়া হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের হাত ধরে সূচিত হয়েছিল বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। তারই প্রবহমান ধারায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালির যে বিজয়, তা আজ মহিরুহ।

কবি সৈয়দ শামসুল হক তাই বলেছেন, ‘পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-/কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।/ শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;/অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;/একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;/আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।/এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/ তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-/চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উলটো পথে চলার যে ভ্রমণ শুরু হয়েছিল, তা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোধ করেছেন। মোট চারবার ও টানা তৃতীয়বার তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যকরের মধ্য দিয়ে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে জাতি। দেশের মানুষ স্বাধীনতা ও বিজয়ের স্বাদ নিতে পারছে প্রাণভরে। বাংলাদেশের আজকের যে উন্নয়ন, তা মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বের হাত ধরে দেশের সব শ্রেণি-পেশা, দলমতনির্বিশেষে মানুষের শ্রম ও মেধার ফসল।

বাংলাদেশের এই বিজয়ের সঙ্গে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। সেই ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধির, তেমনই শোষণের। সেই সঙ্গে আছে বাঙালির প্রতিবাদ ও সংগ্রামের। প্রাচীন যুগের বঙ্গ, পুন্ড্র, গৌড় কিংবা গঙ্গাঋদ্ধির এই জনপদ শাসন করেছে মৌর্য, পাল, চন্দ্র, সেন রাজবংশ।

পৃথিবীর বুকে এই ভূমি তখন সবচেয়ে দামি ও সমৃদ্ধিশালী। পরবর্তীকালে মোগল শাসনামলের পরে ইংরেজদের দুইশ বছরের শাসনের ইতিহাসও নিপীড়ন, নির্যাতন, লুণ্ঠন আর বাংলাকে চুষে নেওয়ার।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ধর্মের ভিত্তিতে ‘পাকিস্তান’ ও ‘ভারত’ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে আজও বিবেচনা করা হয় এই অঞ্চলের রাজনীতির সবেচেয়ে বড় অদূরদর্শী ভাবনা হিসাবে। পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মধ্যেই বাঙালি বুঝতে পারে সে নতুন জাঁতাকলে পিষ্ট হতে যাচ্ছে।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত বাঙালি তার ভাষার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা ‘বাংলা’র সম্মানকে সমুন্নত রাখে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলা’র দাবিতে ঝড়ে বুকের তাজা রক্ত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা সরকারের শোষণ-নিপীড়ন চলতেই থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসেন।

ধীরে ধীরে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন বাংলার মানুষকে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফায় বাঙলির মুক্তিসনদ দেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পেরিয়ে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সামরিক জান্তা আইয়ুব সরকারের পতন হয়। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি খুব। তারপরই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় খুনি ইয়াহিয়া।

১৯৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের টালবাহানা। মুক্তিকামী বাঙালিকে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের দীপ্ত ভাষণে মুক্তির দিকনির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে এক ভয়াবহ দিন।

সেই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন্স সার্চলাইট’ নামে মানবসভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যা চালায় ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। সব আলোচনা ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বেতার বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির ললাটে ধরা দেয় বিজয় আনন্দ। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধুকে দিল্লিতে বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছেন। আর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসন লাভ করে।

সরকার গঠনের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গঠনের জন্য একটার পর একটা উদ্যোগ নিতে থাকেন। কিন্তু ঘাতকের দল চেয়েছিল ভিন্নকিছু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তার পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসাবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে হত্যা করা হয়।

একই বছর ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে। খন্দকার মোশতাকের সাময়িক ক্ষমতা পাওয়ার পট পেরিয়ে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

তার আগেই ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে অনেক ক্যুর মধ্য দিয়ে সামরিক কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে সরকারের পতন হয়। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

১৯৯০ সালে তার বিদায়ের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এই সরকারের মেয়াদ শেষে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সরকার ক্ষমতায় আসে। সেনা সমর্থিত এই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে।

তাদের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রায় একযুগ ক্ষমতায় রয়েছে দলটি।

কর্মসূচি : যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস-২০২১ উদযাপনের লক্ষ্যে এবার জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর (আজ) ঢাকায় প্রত্যুষে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা করা হয়।

সূর্যোদয়ের পর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ প্রতিপাদ্যে বর্ণাঢ্যভাবে শুরু হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের লক্ষ্যে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা।

যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত এ অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকাল সাড়ে ৪টায়।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পরিচালনায় থাকবে সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের শপথ। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।

শপথগ্রহণ শেষে আলোচনা পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। অতিথির বক্তব্য দেবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেবেন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

আলোচনা পর্ব শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা অতিথিকে ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধাস্মারক প্রদান করবেন এবং এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত দুটি স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হবে।

সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীসহ দেশের বরেণ্য শিল্পীদের পরিবেশনায় বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।

সকাল সাড়ে ১০টায় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমভিত্তিক যান্ত্রিক বহর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীও এ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে।

Pin It