বিশেষ ছাড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন

image-706667-1691957510

নিয়মনীতির শিথিলতার সুযোগ নিয়ে গত বছর ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নবায়ন করেও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না। গত এক বছর ব্যাংকিং খাতে ৬৩ হাজার ৭২০ (প্রায় ৬৪ হাজার) কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এত বিপুল অঙ্কের ঋণ নবায়নের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মার্চ পর্যন্ত তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে বিশেষ ছাড়ের আওতায় ২৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল। এক বছরের ব্যবধানে আড়াই গুণের বেশি খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। বিশেষ ছাড়ের আওতায় নবায়ন করা ঋণের একটি অংশ পুনরায় খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। গত বছর নবায়ন করা পুনরায় খেলাপি হওয়ার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮৬০ (প্রায় ৪১ হাজার) কোটি টাকা।

রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। আইএমএফ-এর শর্ত ছিল-বছরে কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়, এর তথ্য প্রকাশ করা। ওই শর্তের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রথমবারের মতো এসব তথ্য প্রকাশ করল। একই সঙ্গে আইএমএফ-এর শর্ত ছিল খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রধান ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ নবায়নের প্রক্রিয়ার ব্যাপকভাবে অপব্যবহার হচ্ছে। প্রণোদনা বা বিশেষ ছাড়ের আওতায় খেলাপি ঋণ একবার নবায়ন করা হচ্ছে, শর্ত অনুয়ায়ী কিস্তি দিচ্ছে না। ফলে আবার সেগুলো খেলাপি হচ্ছে। আরও ছাড় দিয়ে পুনরায় নবায়ন করা হচ্ছে। এভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নবায়নের খেলা চলছে। ব্যাংক খাতকে স্বচ্ছ রাখতে এসব খেলা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। তা না হলে সামনে বড় সমস্যা হবে। তিনি আরও বলেন, ঋণ নবায়নের নামে প্রলেপ দিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে রাখা হচ্ছে। যেগুলো পুনঃতফশিল করা হয়, সেগুলো মূলত খেলাপি ঋণ। পুনঃতফশিলের পরও তা খেলাপি থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তিন-ছয় মাস পরই আবার খেলাপি হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণের তথ্য আড়াল করে রাখা মোটেই সুখকর নয়। বরং খেলাপি ঋণকে প্রকাশ করে খেলাপিদের ও ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। এতে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো সম্ভব হবে। লুকিয়ে রাখলে আদায় করা যাবে না। বরং খেলাপিদের আরও সহায়তা করা হবে।

ড. মইনুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মোট ঋণের কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এখন খেলাপি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখাচ্ছে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশ।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালে বিশেষ ছাড়ের আওতায় ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপি গ্রাহকরা ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছেন। ২০২১ সালে বিশেষ ছাড়ের আওতায় নবায়ন করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ নবায়নের প্রবণতা বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গত চার বছরের মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে কম ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। কারণ ওই বছরে করোনার কারণে বিশেষ ছাড়ের আওতায় ঋণ পরিশোধ না করলেও তা খেলাপি করা হয়নি। ওই বছর ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। করোনার আগে ২০১৯ সালে রাজনৈতিক কারণে খেলাপি ঋণ নবায়নে আরও বড় ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ে ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল।

এদিকে নবায়ন করা ঋণের মধ্যে বেশকিছু ঋণের কিস্তি নিয়মিত গ্রাহকরা পরিশোধ করছেন না। ফলে ওইসব নবায়ন করা ঋণ আবার খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে এসব ঋণ পুনরায় খেলাপি হওয়ার কারণে এর স্থিতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছরে যা নবায়ন হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি নবায়ন করা ঋণের স্থিতির পরিমাণ বেশি হচ্ছে। ২০২২ সালে নবায়ন করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হওয়ার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এসব ঋণ খেলাপি থেকে নবায়ন করা হয়েছিল। নবায়নের শর্ত অনুযায়ী কিস্তি পরিশোধ না করায় সেগুলো পুনরায় খেলাপি হয়েছে। ২০২১ সালে এ ঋণের স্থিতি ছিল ৩২ হাজার ৯৬০ কোটি, ২০২০ সালে ২৯ হাজার ৯৩০ কোটিা এবং ২০১৯ সালে ২৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা।

প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চার বছর ধরে খেলাপি ঋণ নবায়ন করার প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনই নবায়ন করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হওয়ার প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতে একদিকে প্রলেপ দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো হচ্ছে, অন্যদিকে ছাড়ের সুবিধার অপব্যবহার করায় পুনরায় খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নবায়ন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে নবায়ন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এ ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪১০ কোটি, ২০২০ সালে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ নবায়নের স্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। চার বছরের ব্যবধানে নবায়নের স্থিতি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত করে রাখা হচ্ছে। নবায়ন করা ঋণের মধ্যে নিয়মিত থাকা ঋণের স্থিতি খুব বেশি বাড়ছে না। ২০১৯ সালে নবায়ন করা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা বেড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা হয়েছে। ২০২১ সালে তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল খেলাপি। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণই ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ নবায়নের মধ্যেও আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৪৬ শতাংশই রয়েছে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে। যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যাংকে আছে ৫৪ শতাংশ, যার পরিমাণ ৬৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। শীর্ষ ১০ ব্যাংকে আছে ৭৮ হাজার ১৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ, অর্থাৎ ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যান্য ব্যাংকে আছে ৪২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ।

মোট আমানতের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে রয়েছে ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যান্য ব্যাংকে আছে ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মোট সম্পদের ১০ ব্যাংকেই রয়েছে ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ তিনজন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে ১০ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়াবে।

১০ শতাংশের কম মূলধন রয়েছে ১১টি ব্যাংকের। কম মূলধন থাকায় এসব ব্যাংক ঝুঁকিতে। ১০ শতাংশের বেশি থেকে সাড়ে ১২ শতাংশের কম মূলধন আছে ৫টি ব্যাংকের। বাকি ব্যাংকগুলোর মূলধন সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি।

Pin It