রমজানের বাজার ৬৬ ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে

Chal-Dal-5cc0b56abddb4

রমজান সামনে রেখে রেকর্ড পরিমাণ পণ্য এসেছে। তারপরও দাম বাড়ছে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের। এর মধ্যে রয়েছে ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, খেজুর, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গুদামে পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে ৬৬ ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট। এসব গুদামের বেশির ভাগই রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায়।

আমদানি করা পণ্যের ৭০ শতাংশই মজুদ আছে এসব প্রতিষ্ঠানের গুদামে।

সাধারণত রমজান শুরুর মাস দুয়েক আগে পণ্য আসে। কিন্তু এবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রমজানের পণ্য এসেছে ছয় মাস আগে থেকে। এদিকে পণ্য আমদানির পরও যারা দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন, তাদের শক্ত হাতে থামাতে দেশের প্রত্যেক বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি পাঠিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে কি-না, সে দিকে নজর রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘পণ্য মজুদ রেখে কেউ যাতে মনোপলি ব্যবসা করতে না পারে সে জন্য প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। বাজার তদারকি করতে ভ্রাম্যমাণ টিম গঠনসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নজরদারি আছে বিভিন্ন গুদামেও। কার কাছে কী পণ্য আছে সংগ্রহ করা হয়েছে সেসব তথ্যও। কেউ যদি পণ্য গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে চায়, তবে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ টিম।’ চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘যত পণ্য এসেছে, তাতে বাজার স্থিতিশীল থাকার কথা। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে প্রশাসনকে। পাইকারির পাশাপাশি খুচরা বাজারেও মনিটর জোরদার করতে হবে।’

ছোলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে নয় প্রতিষ্ঠান :২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সর্বশেষ ছয় মাসের আমদানি চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রমজান উপলক্ষে এবার পর্যাপ্ত ছোলা এসেছে। রোজায় গড়ে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন ছোলার চাহিদা দেখা দেয়। সেখানে গত ছয় মাসে ছোলা আমদানি হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৯৯৩ টন। ৭৪ জন ব্যবসায়ী এসব ছোলা দেশে আনলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠান। তারা দুই হাজার ৩০০ টন থেকে সর্বোচ্চ ২৩ হাজার ৩০০ টন ছোলা এককভাবে আমদানি করেছে।

আমদানি চিত্র অনুযায়ী, ছোলার সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে রুবি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের কাছে। গত ছয় মাসে তারা ২৩ হাজার ৩০০ টন ছোলা আমদানি করেছে। এককভাবে ১১ হাজার ২৫ টন ছোলা আমদানি করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে টোয়ো ফিড লিমিটেড। এ ছাড়া এ কে করপোরেশন ছয় হাজার ২৮১ টন, হোসেন অটোম্যাটিক ডাল মিল পাঁচ হাজার ৮৩৭ টন, মাসুদ ট্রেডিং কোম্পানি চার হাজার ৮০০ টন, লাভলী স্টোর তিন হাজার ৫৫০ টন, পাপড়ি ট্রেডার্স দুই হাজার ৯১৬ টন, মেসার্স আবদুল ওহাব দুই হাজার ৪০৭ টন ও মেসার্স শামসুল আলম দুই হাজার ৩৫৩ টন ছোলা আমদানি করেছে। দুই হাজার টনের নিচে কিন্তু এক হাজার টনের ওপরে ছোলা আমদানি করেছে এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৬টি।

মটর ডালের বাজার ৯ ব্যবসায়ীর হাতে :মটর ডাল আমদানি করা ব্যবসায়ী ৪১ জন। তবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ৯ ব্যবসায়ীর হাতে। রুবি ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড এককভাবে সর্বোচ্চ এক লাখ ৩০ হাজার টন মটর ডাল আমদানি করেছে এবার। সাড়ে ২৭ হাজার ও সাড়ে ২৩ হাজার টন মটর ডাল আমদানি করে এ তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে মেসার্স শেখ ব্রাদার্স ও বসুন্ধরা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড। দুই হাজার টনের বেশি ও আট হাজার টনের নিচে মটর ডাল আমদানি করা শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- কমোডেটিস ট্রেডিং কোম্পানি, মাসুদ ট্রেডিং কোম্পানি, মেসার্স আর এস ট্রেডিং, অর্পিতা ট্রেডার্স ও মেসার্স বিলাস চন্দ্র সাহা।

১৭ ব্যবসায়ীর গুদামে সর্বোচ্চ মসুর ডাল :মসুর ডাল আমদানি করা প্রতিষ্ঠান ৭২টি থাকলেও সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি করার মাধ্যমে এখন সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে ১৭ ব্যবসায়ীর গুদামে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- রুবি ফুড প্রোডাক্ট, মেসার্স এন আর ট্রেডিং, মেসার্স শেখ ব্রাদার্স, মেসার্স চিটাগাং ফিস প্রোডাক্টস, লাভলী স্টোর, মেসার্স এন আর ট্রেডিং, চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ, এক্সপোর্ট ট্রেডিং বিডি, আফজাল ফুড প্রোডাক্ট, লাকী ট্রেডিং, অরিট করপোরেশন, বেঙ্গল ট্রেডিং, হোসেন অটোম্যাটিক ডাল মিল, মেসার্স আর এস ট্রেডিং, মাসুদ ট্রেডিং কোম্পানি, লাকী ট্রেডিং ও অর্পিতা ট্রেডার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রুবি ফুড এককভাবে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার ১৫৪ টন মসুর ডাল আমদানি করেছে। অন্য প্রাতষ্ঠানগুলো আড়াই হাজার টনের ওপরে কিন্তু ১৬ হাজার টনের নিচে মসুর ডাল আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

১৫ প্রতিষ্ঠানের হাতে খেজুরের বাজার :চাহিদার তুলনায় এবারও বেশি এসেছে খেজুর। শুকনা ও ভেজা খেজুর আমদানিকারক শতাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র ১৫টি প্রতিষ্ঠান। ১০০ টনের ওপরে কিন্তু ৫০০ টনের নিচে খেজুর আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- এরাবিয়ান ডেটস ফ্যাক্টরি, রয়েল ফ্রেস ফুডস, সাপোয়ানা ফুড ট্রেডিং করপোরেশন, মদিনা ফুডস লিমিটেড, রামিসা বিডি লিমিটেড, এডি ফ্রুটস লিমিটেড, আল্লাহর রহমত স্টোর, হৃদয় এন্টারপ্রাইজ, সাউদার্ন ট্রেডিং, জেবি অ্যান্ড ব্রাদার্স, এডি ফ্রুটস লিমিটেড, জেসপার ট্রেডিং, ওয়াসিফ ট্রেডিং, আল আনসার ফুডস, আস সাফা ওয়াল মারওয়া ট্রেডিং।

আমদানি করা চিনির ৯০ শতাংশ মজুদ আছে সিটি গ্রুপ, আবদুল মোনেম গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপের কাছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করা শীর্ষ ১২ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- দীপা ফুড প্রোডাক্ট, মেঘনা এডিবয়েল, শবনম ভেজিটেবল অয়েল, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, বাংলাদেশ এডিবয়েল, সুপার অয়েল রিফাইনারি, বিওটিটি অয়েল রিফাইনারি, মোস্তফা অয়েল প্রোডাক্ট, বে ফিশিং করপোরেশন, ফারজানা অয়েল রিফাইনারিজ, এস আলম সুপার এডিবয়েল ও রূপসা এডিবয়েল। ৬টি শিল্প গ্রুপের এসব প্রতিষ্ঠান দেশে আসা ক্রুড অয়েলের ৯০ শতাংশই আমদানি করেছে।

দেশে পেঁয়াজের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে ভারতীয় পেঁয়াজ। যার বেশিরভাগই আমদানি হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অল্প কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয় চীন থেকে। সর্বশেষ ছয় মাসে এখান দিয়ে পেঁয়াজ এসেছে ২১৬ টন। ১২ ব্যবসায়ী এ পেঁয়াজ আমদানি করলেও এককভাবে সর্বোচ্চ ১২৫ টন পেঁয়াজ এনেছে প্রাণ ফুডস লিমিটেড। এর বাইরে ১১ টনের নিচে কিন্তু ১০ টনের ওপর পেঁয়াজ আমদানিকারক আছে মাত্র চারজন।

Pin It