রাজস্ব আহরণ ও নিট রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ

image-668472-1682453244

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের বিপরীতে শর্ত পূরণে পিছিয়ে আছে রাজস্ব আহরণ ও নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ দুই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটি।

একই সঙ্গে নিট রিজার্ভ গড়ে তোলা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের ব্যপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গেও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে এসব আলোচনা করেছে সফররত আইএমএফ’র প্রতিনিধি দল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এর আগে আইএমএফ’র শর্ত পূরণে ভর্তুকি কমাতে দুদফা জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয়। সংস্থাটি চাচ্ছে ভিন্ন একটি পদ্ধতি দাঁড় করাতে যেখানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও হ্রাসের সঙ্গে দেশের বাজারে প্রতিফলন ঘটবে।

বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে তাদের দেওয়া শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ এ দলের সঙ্গে আসেননি। কারণ ১ মে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইএমএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভার একটি বৈঠক হওয়ার কথা। ওই বৈঠকে মিশন প্রধান হিসাবে উপস্থিত থাকবেন রাহুল আনন্দ। বৈঠক শেষে ঢাকায় ফিরে এই দলের সঙ্গে যোগ দেবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সফরের প্রথম দিনের প্রথমার্ধে সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের কর্মকর্তা এবং দুপুরে সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রতিনিধি দলের একটি অংশ। অপর অংশ বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে।

আইএমএফ’র ঋণের শর্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছরের অতিরিক্ত কর আদায় বাড়াতে হবে মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ওই হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমপক্ষে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আহরণ করতে হবে। এ বিষয়ে বৈঠকে আইএমএফ জানতে চেয়েছে কিভাবে এবং কোন কৌশলে এই অতিরিক্ত কর আহরণ করা হবে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ’র প্রধান উদ্বেগ হচ্ছে রাজস্ব আদায় নিয়ে। আইএমএফ প্রতিনিধিরা বলেছেন, বিপুল অঙ্কের বর্ধিত রাজস্ব আয়ের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা? কোন ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত কর আদায় হবে। এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন করা হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আদায়ে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়েছে। তারা আশা করছে নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে। এরপরও এ খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছে আইএমএফ।

সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে চলতি সংশোধিত বাজেট এবং আগামী অর্থবছরের বাজেটে কত টাকা ব্যয় হবে সেটিও জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া বর্তমান অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও পরবর্তী উত্তরণের পদক্ষেপগুলো নিয়েও আলোচনা হয়। অপরদিকে মধ্যবর্তী অর্থবছরের (২০২৪-২৭) বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং ঘাটতি অর্থায়নে ৪ ভাগের ১ অংশ সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইএমএফ’র শর্তে উলে­খ আছে, ২০২৬ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার অঙ্ক মোট ঘাটতির ৪ ভাগের ১ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে। বিষয়টি অর্থ বিভাগের নজরে আনা হয়।

সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) লোকসানের তথ্য চাওয়া হয়। এই তিন সংস্থাকে বাজেট থেকে কি ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে সেটি জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া বিদেশি ঋণ, জ্বালানি আমদানি ব্যয়, করোনা পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এদিকে আইএমএফ’র শর্তে আছে জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন (২৪৪৬ কোটি ) ডলার থাকতে হবে। বর্তমান মোট রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন (৩১১৮ কোটি) ডলার আছে। অর্থ বিভাগের হিসাবে এরমধ্যে নিট রিজার্ভ সম্ভাব্য ১৯ থেকে ২০ বিলিয়ন (২০০০ কোটি) ডলার হবে। ফলে আগামী ২ মাসে নিট রিজার্ভে পৌঁছতে আরও ৪৫০ কোটি ডলার প্রয়োজন। যা অনেকটাই অসম্ভব। এ নিয়ে সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, জুনের মধ্যে আইএমএফ যেসব শর্ত পূরণ করতে বলেছে তার মধ্যে রাজস্ব আদায় ও নিট রিজার্ভ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছে। নিট রিজার্ভ হিসাবের বিষয়টি পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে। তবে আগামী ২ মাসে রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা কিছু যোগ হবে, কিছু খরচও হবে। এরপরও নিট রিজার্ভ হিসাবে এখন ঘাটতি প্রায় সাড়ে চারশ কোটি ডলার রয়েছে। যা সমন্বয় সম্ভব হবে না।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, জুনের মধ্যে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে আইএমএফ’র শর্ত পূরণ নাও হতে পারে। তবে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সংস্থাটির স্টপ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থেকে একটি ছাড়পত্র প্রয়োজন হবে। নরমালি ওয়েভার চাইতে গেলে ঋণের সুদ হারের ক্যাপ তুলে দেওয়া, মুদ্রা বিনিয়ম হার বাজার ভিত্তিক করার অঙ্গীকার চাইতে পারে সংস্থাটি। তিনি আরও বলেন, ঋণের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। সেগুলো কিভাবে মিট করবে এখন দেখার বিষয়।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান আলোচনায় আসে রিজার্ভ পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে। বর্তমান দেশে মূল্যস্ফীতির হার, আগামীতে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা এবং এর নিয়ন্ত্রণের কৌশল সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ করিডোর কার্যকর কবে নাগাদ হবে সেটিও জানতে চাওয়া হয়। অবশ্য করিডোর কার্যকর হলে বর্তমান ঋণের সুদের ওপর আরোপিত ক্যাপ উঠে যাবে। আর তাতে ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়বে। এছাড়া বাজার ভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু নিয়েও সেখানে আলোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দল বৈঠক করেছে। সংস্থাটি ঋণের সুদ হার, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা কিছু তথ্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য পরিবেশন করছি।

Pin It