শীর্ষ খেলাপিকে ফের ঋণ দেওয়ার তোড়জোড়

Untitled-24-5d4b2c61672b6-5d4b4b918db49

ভুয়া কাগজ তৈরি করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাজ্জাকুল হোসেন রফতানির নামে অর্থ পাচার করেছেন বলে তথ্য পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব কারণে ৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে জনতা ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো প্রতিষ্ঠানটির  মালিককে বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ফলে ২০১৩ সালের ১০৯ কোটি টাকা থেকে এখন ঋণের পরিমাণ এক হাজার ২৩৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে, যার বড় অংশই খেলাপি। এর পরও নতুন করে একই মালিকের প্রতিষ্ঠানকে এলসির মাধ্যমে আরও ৭৫১ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়ার তোড়জোড় করছে জনতা ব্যাংক।

ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্স, বিসমিল্লাহসহ কয়েকটি গ্রুপের জালিয়াতির কারণে আর্থিক খাতে আলোচিত নাম জনতা ব্যাংক। একক গ্রাহকের ঋণ সীমা অতিক্রম, ভুয়া রফতানি বিল তৈরিসহ নানা অনিয়ম করে এসব প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ১০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে অ্যাননটেক্সের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্ট গ্রুপের খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৫৭২ কোটি টাকা এবং বিসমিল্লাহ গ্রুপের রয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা। এসব কারণে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ এখন জনতায়। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। আর চার হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, মো. রাজ্জাকুল হোসেনের মালিকানাধীন রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস রুট গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। একই গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে রানকা ডেনিম টেক্সটাইল মিলস ও গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি এক হাজার ২২ কোটি টাকা। বিদ্যমান ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালার বাইরে বিশেষ বিবেচনায় ৩ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ৮ বছর মেয়াদে নিয়মিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি চেয়েছে জনতা ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের আলোকে গত ২৮ জুলাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়। তবে নানা অনিয়মে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন গ্রহণ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর একক গ্রাহকের ঋণ সীমা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে শিথিলতার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ‘জনতা ভবন করপোরেটের গ্রাহক প্রতিষ্ঠান গ্রাম বাংলা এনপিকে, রানকা ডেনিম ও রানকা সোহেল কম্পোজিটের ঋণ পুনঃতফসিলে অনাপত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রক্রিয়াধীন।’ অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও আরও ৭৫১ কোটি টাকার এলসি সুবিধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এলসি তো এখনও খোলা হয়নি। পুনঃতফসিলের বিষয়টি সমাধানের পর এলসির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’

এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ জানতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রানকা ও গ্রাম বাংলার ঋণ পুনঃতফসিল এবং সার আমদানির এলসি স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও জনতা ব্যাংক কেন নতুন করে এলসি সুবিধা দিতে চায়, তার ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জাতীয় সংসদে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর প্রকাশিত তিনশ’ ঋণখেলাপির তালিকার শীর্ষ ৫০টির মধ্যে রয়েছে রুট গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের নাম। মূলত কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার আমদানির কার্যাদেশ পাওয়ায় এলসি খোলার জন্য এসব ঋণ পুনঃতফসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। যদিও সময়মতো এলসি খুলতে না পারায় এবং প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ঋণখেলাপিসহ নানা অনিয়মের বিষয়টি অবহিত হওয়ায় সার আমদানির ওই কার্যাদেশ বাতিল করে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর পর কার্যাদেশ ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে রিট করেন রাজ্জাকুল হোসেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মন্ত্রণালয়ের কার্যাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে গ্রাম বাংলা জনতা ব্যাংকে এলসি খোলার জন্য জোর তৎপরতা চালিয়ে যচ্ছে। অনিয়মের বিষয়টি জেনেও জনতা ব্যাংক তাকে নতুন ঋণ দেওয়ার জন্য বিদ্যমান খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে চাইছে।

জানতে চাইলে গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাজ্জাকুল হোসেন গতকাল মোবাইল ফোনে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি না পাওয়ায় তিনি সার আমদানি করবেন না।’ তাহলে আদালতে রিট করলেন কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, করেছিলাম। তবে এখন আর আমদানি করতে চাই না।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, ‘তার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়ে গেছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক কেন অনাপত্তি দিল না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর সরাসরি জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেন। তিনি জানান, ‘তরু নামে একজন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’ এর কিছুক্ষণ পর তরু পরিচয়ে একজন ফোন করে এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘স্যার আপনার নাম্বারটা দিয়েছেন। আমি আগামীকাল আপনার সঙ্গে দেখা করব।’ অফিসে এসে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি বলেন, ‘অফিসে না, বাইরে কোথাও।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৩ সালে এক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে জনতা ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় লেনদেন শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের মালপত্র হস্তান্তর না করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শুধু কাগজপত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে সুকৌশলে ১০৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। রফতানির জন্য লন্ডনের বানকিউ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ব্যাংকে এলসি দেখানো হয়, যার বেশিরভাগ অর্থই দেশে আসেনি। ওই সময়ে যে ৬ লাখ ৭১ হাজার ডলার এসেছে বলে দেখানো হয়, তা এসেছিল দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে। যে প্রতিষ্ঠানে রফতানি দেখানো হয়েছিল, তাও ছিল ভুয়া। সার্বিক তথ্য পর্যালোচনায় আদৌ রফতানি হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এসব অনিয়মের দায়ে তখন রানকা সোহেল কম্পোজিটের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রমনা করপোরেট শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মুহাম্মদ মিজানুর রহমান ও সেকেন্ড অফিসার (এজিএম) কাজী রইস উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের পক্ষ থেকে মিজানুর রহমান ও রইস উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলেও রানকা সোহেলকে দেওয়া হয়েছে নতুন সুবিধা। জালিয়াতির এ ঋণ তখন রমনা করপোরেট শাখা থেকে স্থানান্তর করে নেওয়া হয় জনতা ভবন করপোরেট শাখায়। এর পর ঋণ আদায়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে এ পর্যায়ে এসেছে।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জন্য ১১ লাখ ৭৫ হাজার টন নন-ইউরিয়া সার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। দরপত্রে অংশ নিয়ে এক লাখ ১৫ হাজার টন সার আমদানির কার্যাদেশ পায় গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার। এর মধ্যে চীন থেকে ৮০ হাজার টন ডিএপি ও ১০ হাজার টন এমএপি এবং মিসর থেকে ২৫ হাজার টন টিএসপি আমদানি করবে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য জনতা ব্যাংকের তিনটি খসড়া এলসির কাগজ দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে পারে না। এ কারণেই নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আগের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত হতে চাইছেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রাজ্জাকুল হোসেন।

কে এই রাজ্জাকুল হোসেন : শীর্ষ ঋণখেলাপি মো. রাজ্জাকুল হোসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নীতিগত অনুমোদন পাওয়া তিনটি নতুন ব্যাংকের মধ্যে পিপলস ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা এমএ কাশেমের। প্রস্তাবিত তিন ব্যাংকের মধ্যে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও দ্য সিটিজেন ব্যাংকের সম্মতিপত্র দিলেও আটকে দিয়েছে পিপলস ব্যাংক। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়ে প্রবাসীদের নাম করে সরবরাহের অভিযোগে ব্যাংকটির সম্মতিপত্র বা এলওআই আটকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

Pin It