নিজেকে ফিরে পেতে তামিম ইকবালের তাড়নার তীব্রতায় তছনছ হয়ে গেল জিম্বাবুয়ের বোলিং। সেঞ্চুরি খরা কাটানো ইনিংস সাজালেন রেকর্ডের মালায়। বাংলাদেশের রানও উঠল রেকর্ড উচ্চতায়। জিম্বাবুয়ের রান তাড়ার শুরুও হলো বাজে। তার পরও এই ম্যাচে কিছু থাকে? কিন্তু ক্রিকেট হাজির হলো তার অনিশ্চিত চরিত্র নিয়ে। অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচ জমিয়ে তুলল জিম্বাবুয়ে। শেষ বলের ফয়সালায় জিতে শেষ পর্যন্ত সিরিজ নিশ্চিত করল বাংলাদেশ।
শেষ ভাগে রোমাঞ্চ আর নাটকীয়তার রেশ ছড়ানো দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সিলেটে জিম্বাবুয়েকে ৪ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচ সিরিজে এগিয়ে গেছে ২-০ ব্যবধানে।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের রেকর্ড রান তুলেছিল বাংলাদেশ। পরের ম্যাচেই সেই স্কোর ছাড়িয়ে বাংলাদেশ করেছে ৩২২।
জিম্বাবুয়ে এবার অসহায় হার মানেনি। শুরুটা ভালো না হলেও মিডল ও লোয়ার-মিডল অর্ডারের সৌজন্যে জাগিয়ে তোলে অবিশ্বাস্য এক জয়ের সম্ভাবনা। শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি, থেমেছে ৩১৮ রানে।
শেষ ওভারে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ছিল ২০। তৃতীয় ও চতুর্থ বলে আল আমিন হোসেনকে টানা দুটি ছক্কায় চমকে দেন ডনাল্ড টিরিপানো। শেষ ২ বলে প্রয়োজন ছিল ৬ রান। পঞ্চম বলে আল আমিনের বাউন্সারে আসেনি কোনো রান। শেষ বলে কেবল সিঙ্গেল।
শেষের উত্তেজনা বদলে দিয়েছে ম্যাচের পুরো আবহ। নইলে ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিল কেবলই তামিম-ময়!
১৩৭ বলে ১৫৮ রানের অসাধারণ ইনিংসে তামিম গড়েছেন দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের কীর্তি। ছাড়িয়ে গেছেন নিজেরই ১৫৪ রানের রেকর্ড।
ম্যাচের আগে তামিমকে নিয়ে চলছিল তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। ব্যাটে বড় রান আসছিল না দীর্ঘ দিন ধরে। ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে চলছিল প্রশ্নের ঝড়। সেই মাতাল হাওয়ায় উড়ে না গিয়ে প্রতিউত্তর দিলেন প্রবল প্রতাপে।
ইনিংসটির পথে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ছুঁয়েছেন ৭ হাজার রান। ২০টি চার মেরে ছাড়িয়ে গেছেন নিজেরই রেকর্ড।
জিম্বাবুয়ে একটা ধাক্কা হজম করে ম্যাচের আগে। চোটের কারণে নামতে পারেননি অধিনায়ক চামু চিবাবা। নেতৃত্ব দেন দলে ফেরা শন উইলিয়ামস। মুস্তাফিজুর রহমান ও আগের ম্যাচে দারুণ পারফর্ম করা সাইফ উদ্দিনকে বিশ্রাম দিয়ে শফিউল ইসলাম ও আল আমিনকে ফেরায় বাংলাদেশ।উইকেট আগের ম্যাচের মতোই ব্যাটিং সহায়ক, আবার টস জিতে মাশরাফি বেছে নেন ব্যাটিং। ঠিক আগের ম্যাচের মতোই প্রথম ওভারে দৃষ্টিনন্দন একটি বাউন্ডারিতে শুরু করেন লিটন।
তবে এ দিন আর বেশিদূর এগোতে পারেননি লিটন। তামিমের ড্রাইভে বোলারের হাতের ছোঁয়ায় নন স্ট্রাইক প্রান্তে রান আউট হয়ে যান দুর্ভাগ্যজনকভাবে।
তিনে নামা নাজমুল হোসেন শান্ত রান আউট হন তামিমের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে। তবে তামিম বাউন্ডারির ফোয়ারায় শুরু করেছিলেন বলেই ২ উইকেট হারানোর পরও দলের স্কোরকার্ডের চেহারা ছিল বেশ ভালো।
আগের ম্যাচে দশম ওভারে গিয়ে প্রথম বাউন্ডারি পেয়েছিলেন তামিম। এই ম্যাচে ১০ ওভারেই বাউন্ডারি মেরেছেন ১০টি। ৪২ বলে স্পর্শ করেছেন ফিফটি।
চারে নেমে মুশফিকুর রহিম শুরু থেকেই ছিলেন সাবলীল। নিজের মতোই সুইপ-রিভার্স সুইপে রান বাড়িয়েছেন দ্রুত।
বড় কিছুর আভাস ছিল মুশফিকের ব্যাটেও। কিন্তু তার ৫০ বলে ৫৫ রানের ইনিংস শেষ হয়েছে হতাশাজনক শটে। অফ স্পিনার ওয়েসলি মাধেভেরেকে ছক্কা মারতে গিয়ে ধরা পড়েছেন সীমানায়। ভেঙেছে ৮৭ রানের জুটি।পরের জুটিতে এসেছে শতরান। তামিমকে সঙ্গ দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। তবে ছন্দ পেতে কিছুটা সময় লেগেছে মাহমুদউল্লাহর। সে সময় রানের গতি কমে যায় কিছুটা। জুটিতে এসেছে ১০৬ রান।
১০৬ বলে তামিম স্পর্শ করেছেন ক্যারিয়ারের দ্বাদশ সেঞ্চুরি। এর পর তামিম হয়ে ওঠেন আরও অপ্রতিরোধ্য। তুলোধুনো করে ছেড়েছেন জিম্বাবুয়ের বোলারদের। টিনোটেন্ডা মাটুমবোদজির টানা চার বলে মেরেছেন তিন চার ও এক ছক্কা। ওই ওভার থেকে এসেছে ২৪ রান।
মাহমুদউল্লাহ থিতু হলেও শেষ করে আসতে পারেননি কাজ। ৫৭ বলে করেছেন ৪১। তামিমকে থামানো যায়নি। ১৩২ বলে ছুঁয়েছেন দেড়শ। পরের বলেই ছক্কায় নতুন রেকর্ড। ওই ওভারেই আরেকটি ছক্কা মারতে গিয়ে ধরা পড়েছেন সীমানায়।
শেষ দিকে প্রত্যাশিত দ্রুততায় রান পায়নি বাংলাদেশ। রান যা বাড়ানোর, করেছেন মোহাম্মদ মিঠুন একাই। ঝড় তুলতে পারেননি মিরাজ-মাশরাফিরা। শেষ ১০ ওভারে এসেছে ৮৩ রান, উইকেট পড়েছে ৫টি। আগের ম্যাচে ঝড়ো ফিফটির পর মিঠুন এবার করেছেন ১৮ বলে অপরাজিত ৩২।
রান তাড়ায় জিম্বাবুয়ের শুরুটা ছিল যথারীতি বাজে। শফিউল দ্রুতই ফেরান রেজিস চাকাভাকে। মেহেদী হাসান মিরাজের অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে ব্রেন্ডন টেইলর ফেরেন রান আউটে। মিরাজ পরে বোলিংয়ে নিয়েছেন উইলিয়ামসের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।
উইকেট না পেলেও ৮ ওভারের টানা স্পেলে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে অধিনায়ক মাশরাফি বাড়তে দেননি প্রতিপক্ষের রান।
দারুণ কিছু শটে টিনাশে কামুনহুকামউই পৌঁছে যান ফিফটিতে। তবে ৫১ রান করে এই ওপেনার যখন ফিরলেন, ২৪তম ওভারে জিম্বাবুয়ের রান ৪ উইকেটে ১০২। শঙ্কায় তারা আরেকটি বড় পরাজয়ের।সেখান থেকেই তাদের অকল্পনীয় ঘুরে দাঁড়ানো। যেখানে প্রথমে ছিল প্রতিরোধ পর্ব, এরপর প্রতিআক্রমণ।
ওয়েসলি মাধেভেরে ও সিকান্দার রাজার জুটি জমে ওঠে আস্তে আস্তে। ক্রমে বাড়তে থাকে রান। অভিষেক ম্যাচে নজরকাড়া তরুণ মাধেভেরে দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই পেয়ে যান ফিফটি। রাজা প্রমাণ রেখেছেন তার অভিজ্ঞতার।
৫২ রানে মাধেভেরেকে ফিরিয়ে ৮১ রানের জুটি ভাঙেন তাইজুল। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে মাশরাফি থামান ৫৭ বলে ৬৬ রান করা রাজাকে।
জিম্বাবুয়ের চমকে দেওয়া থামেনি সেখানেই। নয়ে নেমে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন টিরিপানো। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন মাটুমবোদজি। শেষ ৫ ওভারে শফিউল ও আল আমিনের ওপর তাণ্ডব বইয়ে দেন দুজন।
২১ বলে ৩৪ করে মাটুমবোদজি ফিরেছেন শেষ ওভারে। কিন্তু হাল ছাড়েননি টিরিপানো। চেষ্টা করেছেন। পেরে ওঠেননি। ৫ ছক্কায় ২৮ বলে অপরাজিত ৫৫ রানের বিস্ফোরক ইনিংস শেষ হয়েছে একটুর জন্য না পারার হতাশায়। বাংলাদেশ ম্যাচ শেষ করেছে স্বস্তিতে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩২২/৮ (তামিম ১৫৮, লিটন ৯, শান্ত ৬, মুশফিক ৫৫, মাহমুদউল্লাহ ৪১, মিঠুন ৩২*, মিরাজ ৫, মাশরাফি ১, তাইজুল ০, শফিউল ৫*; মুম্বা ১০-০-৬৪-২, টিশুমা ৫-০-৩৫-১, টিরিপানো ৮-০-৫৫-২, মাধেভেরে ৭-০-৩৮-১, রাজা ১০-০-৫৯-০, উইলিয়ামস ৭-০-৩৫-০, মাটুমবোদজি ৩-০-৩৪-০)
জিম্বাবুয়ে: ৫০ ওভারে ৩১৮/৮ (কামুনহুকামউই ৫১, চাকাভা ২, টেইলর ১১, উইলিয়ামস ১৪, মাধেভেরে ৫২, রাজা ৬৬, মুতুমবামি ১৯, মাটুমবোদজি ৩৪, টিরিপানো ৫৫*, মুম্বা ০*; মাশরাফি ১০-০-৫২-১, শফিউল ৯-০-৭৬-১, মিরাজ ৭-০-২৫-১, আল আমিন ১০-০-৮৫-১, তাইজুল ১০-০-৫২-৩, মাহমুদউল্লাহ ৪-০-২২-০)
ফল: বাংলাদেশ ৪ রানে জয়ী
সিরিজ: ৩ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: তামিম ইকবাল