গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই ওলট-পালট এখন কোভিড-১৯ মহামারীতে; তার ঢেউয়ে উল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশও।
ওলট-পালটের এই সময়ে ঘাটতি মেটাতে দাতাদের কাছে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ-সহায়তা চাইছে সরকার।
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৪৫০ কোটি (৪.৫ বিলিয়ন) ডলার সহায়তা চেয়েছে সরকার।
বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থ ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা চলতি অর্থ বছরের মোট বাজেটের ১৩ ভাগের এক ভাগ।
করোনাভাইরাসের ধাক্কায় অর্থনীতির অবস্থা এতটাই নাজুক যে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা এতদিন বাংলাদেশকে বাজেটসহায়তা দিয়ে আসছিল, তাদের বাইরেও অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে এবার এ সহায়তা চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
আর সবার কাছ থেকে ‘ইতিবাচক’ সাড়া পাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরে শুক্রবার বলেন, রাজস্ব আদায় কমে গেছে; রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স, আমদানিসহ সব সূচকই এখন নিম্নমুখী।
“অর্থনীতির এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে; সেই ধারা অব্যাহত রাখতে চাই আমরা। আর সে কারণেই বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার কাছে আমরা বাড়তি ঋণ-সহায়তা চেয়েছি।”
“এখন পর্যন্ত দাতা সংস্থাগুলোর কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো চাওয়া হয়েছে। সবার কাছ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে,” বলেন মুস্তফা কামাল।
লকডাউনে প্রায় মাস নিশ্চল ছিল অর্থনীতি; এখন অবশ্য কিছু বিধি-নিষেধ উঠেছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে এবার ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইএসডিবি) কাছ থেকে চাওয়া হয়েছে ১৯ কোটি ডলার।
এত দিন ধরে বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে মোটা অংকের বাজেট সহায়তা পেয়ে আসছে বাংলাদেশ।
এর বাইরে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ এর ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঋণ পাওয়া যায়। এ অর্থ অবশ্য অনেক সময় বাজেট ঘাটতি মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে। জাইকা ও আইএসডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আগে কখনও বাংলাদেশ বাজেট সহায়তা চায়নি। এ দুই সংস্থা প্রকল্পভিত্তিক কাজে অনুদান ও ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু এবার অর্থমন্ত্রী এ দুই সংস্থার কাছেও বাজেটসহায়তা চেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মুস্তফা কামাল বলেন, “গত ১০ মে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির সঙ্গে টেলিফোনে আমার কথা হয়েছে। ওই আলোচনাতেই ১ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
“আশা করছি, জাইকার কাছ থেকে আমরা প্রথম বারের মতো বাজেট সহায়তা পাব।”
আইএসডিবি তার সদস্য দেশগুলোর জন্য কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ২৩০ কোটি ডলারের যে কৌশলগত প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সেই তহবিল থেকেই বাংলাদেশ অর্থ সহায়তা চেয়েছে।
অর্থমন্ত্রী গত ২৫ এপ্রিল ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ড. বন্দর এম এইচ হাজ্জার সঙ্গে এক টেলিকনফারেন্সে এ সহায়তা চান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক কর্মকর্তা বলেন, “জাইকা ও আইএসডিবি বাজেট সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। আইএসডিবির পক্ষ থেকে চলমান একটি প্রকল্প থেকে অর্থ স্থানান্তর করে বাজেট সহায়তা খাতে দেবে বলে আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
এর আগে গত এক মাস ধরে টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থার কাছে চলতি ও আগামী অর্থবছরের বাজেটে বাড়তি আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।
এর মধ্যে এআইআইবির (চীনভিত্তিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ব্যাংক) কাছে চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটি ডলার এবং আগামী দুই অর্থবছরে ৫০ কোটি ডলার ও করোনাভা্ইরাস মোকাবেলায় ১০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির কাছে চাওয়া হয়েছে ১০০ কোটি ডলার।
এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি মনমোহন পারকাশ বলেন, “বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাজেট সহায়তা হিসেবে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার এডিবির কাছে চেয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে এডিবির দীর্ঘদিনের সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতায় বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। আশা করছি, ম্যানিলায় এ বিষয়ে বৈঠকে একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে।”
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৭০ কোটি ডলার, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে চলমান সহায়তার বাইরে ৫০ কোটি ডলার এবং আইএসডিবির কাছে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ১৫ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে।
শুধু বাজেট সহায়তা হিসাবেই নয়, করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংক ১০ কোটি ডলার, এডিবি বাজেটসহায়তাসহ অন্যান্য খাতে ৬০ কোটি ২৩ লাখ ডলার এবং এআইআইবি ৪৫ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এছাড়া ডেভেলপমেন্ট সাপোর্ট ক্রেডিটের আওতায় বিশ্ব ব্যাংকের কাছে প্রাপ্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ২৫ কোটি ডলার দ্রুত ছাড়ের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাজেট সহায়তার আওতায় ঋণ পেলে সরকার তার ইচ্ছেমতো কাজে অর্থ ব্যয় করতে পারে। আর প্রকল্প ঋণে অনেক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সে সব শর্ত পূরণ না হলে বা একটু এদিক-সেদিক হলে নানা প্রশ্ন তোলে দাতা সংস্থাগুলো; প্রকল্পে অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনাও আছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও কোভিড-১৯ মেকাবেলায় বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে চলেছে। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বড় শিল্পসহ ১২টির মতো প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক করেছে ছয়টি। সবমিলিয়ে সোয়া লাখ কোটি টাকার ১৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
এমনকি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে নগদ অর্থসহায়তা দিচ্ছে সরকার। এতে দরকার হবে সাড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এই বিপুল অর্থ জোগানোর মতো কঠিন পরিস্থিতিতে আগামী ১১ জুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। সে কারণেই উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে কম সুদের ঋণ পেতে জোর চেষ্টা করছেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন, “একদিকে মানুষের জীবন বাঁচানো; অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া- সত্যিই কঠিন মুহূর্ত পার করছি আমরা। শুধু আমাদের নয়; পৃথিবীর সব দেশেরই এ অবস্থা।”
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে নতুন বাজেট দেওয়ার ভাবনা ছিল তাদের।
“কিন্তু সেটা আর এখন হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত হয়ত আড়াই-তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে বাজেট দেওয়া হবে।”
সেক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৫৫ হাজার কোটি থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারণা দেন শামসুল আলম।
“এবার রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির কারণে নতুন বাজেটেও রাজস্বের লক্ষ্য কম ধরতে হবে। সে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতিও কিন্তু বেড়ে যাবে। এ যাবৎ আমরা ৫ শতাংশের নিচে ঘাটতি ধরেই বাজেট দিয়েছি। এবার হয়ত সেটা ৭ শতাংশে ঠেকবে।”
“আর সংকটের এই সময়ে দাতাদের কাছ থেকে যত বেশি অর্থ পাওয়া যাবে ততই ভালো। কেননা, এ সব ঋণের সুদের হার খুবই কম। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আমরা জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,” বলেন তিনি।