সেন্টমার্টিন কি ট্রাম্পকার্ড

image-689108-1687465944

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে রাজনীতির টেবিলে চলছে তুমুল আলোচনা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এমনিতেই রাজনীতির অন্দরমহল সরগরম।

পর্দার আড়ালে তৎপর কূটনীতিকরাও। এর মধ্যে নতুন উপাদান হিসাবে হাজির সেন্টমার্টিন। বিগত কয়েক দিনে জাতীয় সংসদে দ্বীপটি নিয়ে ‘মার্কিনিদের চক্রান্ত’ সম্পর্কে দফায় দফায় বক্তৃতা হয়েছে। এবার খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে সেন্টমার্টিন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহের কথা বলার পর আলোচনার পালে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

সচেতন মহলসহ অনেকে এখন চোখ-কান খাড়া করে প্রকৃত সত্য জানার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পর্যবেক্ষক মহলের কারও কারও প্রশ্ন-তাহলে এই দ্বীপ কি এখন ক্ষমতায় থাকা না থাকার ‘ট্রাম্পকার্ড’? জনগণ জানতে চায়-এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে কার কথা সত্য-সরকারের, না যুক্তরাষ্ট্রের। বিষয়টির সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত। ফলে পুরো বিষয় জনগণের সামনে সরকারের পরিষ্কার করা জরুরি।

প্রধানমন্ত্রী যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ করেননি, তবুও মার্কিন দূতাবাস এই ইস্যুতে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিনসহ বাংলাদেশের কোনো ভূখণ্ড দাবি করেনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাজনৈতিক কৌশল।

সেন্টমার্টিন নিয়ে আলোচনা এবারই প্রথম নয়। আশির দশকেও এ বিষয়ে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছিল। তখন বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে একটি সামরিক ঘাঁটি করতে চায়। বিশ্বের আশিটির মতো দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে। ফলে সেন্টমার্টিনে তাদের প্রত্যাশিত ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কৌশলের অংশ।

বিশেষ করে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বলয়ের বিস্তার ঠেকাতে ভূ-রাজনীতির এমন কৌশল জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। ওই সময়ে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো মার্কিনবিরোধী স্লোগানে রাজপথ উত্তপ্ত করে। যদিও শেষ পর্যন্ত চাউর হয় যে, প্রবালসমৃদ্ধ সেন্টমার্টিনের মাটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি করার উপযুক্ত নয়। দ্বীপটির মাটি অত্যন্ত নরম। সামরিক ঘাঁটি করার জন্য মাটির নিচে যে পরিমাণ স্থাপনা করতে হয় তার জন্য ওই দ্বীপের নরম মার্টি অনুপযুক্ত।

আবার এমন কথাও আছে যে, আশির দশক থেকে এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রযুক্তি সেন্টমার্টিনে ঘাঁটি করতে সক্ষম। তবে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নথি কিংবা প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেননি।

জাতিসংঘের সমুদ্র আইন ১৯৮২ অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হলেও সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপকে নিজেদের অংশ দাবি করে মিয়ানমার তাদের মানচিত্রে দ্বীপটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেন্টমার্টিনে যুক্তরাষ্ট্র একটি মেরিন একাডেমি করতে চায় বলেও লোকমুখে কথা চলতে থাকে।

মেরিনরা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে চৌকশ বাহিনী, যাদের ত্রিমাত্রিক দক্ষতা রয়েছে। তবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র কেউই এমন কথা বলেনি।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পেতে আগ্রহী-না এটা এখন একটা রাজনৈতিক চাল তা নিয়েও চলছে বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, সেন্টমার্টিন বিদেশিদের কাছে ইজারা দিলে তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতার জন্য দেশ বিক্রি করবেন না।

গত ১৪ জুন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপটিকে পাওয়ার লক্ষ্যে চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। এজন্য তারা রেজিম চেঞ্জ (সরকার হটানো) চায়।

জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। রাশেদ খান মেনন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যারা বন্ধু, তাদের শত্রুর প্রয়োজন নেই। বেশ কিছু সময় আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার বাগে রাখতে স্যাংশন দিয়েছে। এখন নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এটা কেবল দুরভিসন্ধিমূলকই নয়, তাদের রেজিম চেঞ্জের কৌশলের অংশ। তারা সেন্টমার্টিন চায়, কোয়াডে বাংলাদেশকে চায়।

মেনন বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ছিনিয়ে নিতে তারা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠায়। তীব্র খাদ্য সংকটের সময় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিব্রত করতে মধ্যসমুদ্র থেকে গমের জাহাজ ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে তাদের কালো হাত ছিল। এখন আবার বর্তমান সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে তারা সব কিছু করছে। এরপর জাসদ সভাপতি সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও একই সুরে কথা বলেন। তবে এবার প্রধানমন্ত্রী নিজে বলার পর বিষয়টির গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে আসা বক্তব্যগুলো হুজুগে মন্তব্য। আমাদের আশপাশে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ রয়েছে। ফলে সেন্টমার্টিনে তাদের ঘাঁটি করার প্রয়োজন নেই। এ ধরনের আবেগী মন্তব্য না করাই ভালো।

জানতে চাইলে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বৃহস্পতিবার বলেন, ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে সেন্টমার্টিনের লোকেশন ভারত মহাসাগরের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। বলা হয়ে থাকে, ভারত মহাসাগর যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তারা গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ভারত মহাসাগরের একেবারে কেন্দ্রে আছে ভারত, পাশে চীন এবং দূরবর্তী অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ভারত মহাসাগরের বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সেন্টমার্টিনে সামরিক ঘাঁটি করতে চাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তিনি অবশ্য এটা বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে সেন্টমার্টিন চেয়েছে কিনা কিংবা অনানুষ্ঠানিকভাবে চাওয়ার কোনো ইঙ্গিত দিয়েছে কিনা, সেটা তিনি জানেন না। এ ব্যাপারে সরকার ভালো বলতে পারবে।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম শফিউল্লাহ বলেন, কোনো সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ড কোনো দেশ ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে চাইতে পারে না। সেন্টমার্টিন কারও সম্পত্তি নয় যে, এটা আমরা কাউকে দিয়ে দেব। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ ধরনের মন্তব্য অবান্তর ও অতিরঞ্জিত। সরকারের তরফে এ ধরনের মন্তব্য মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা। উচ্চমহল থেকে এমন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

সিকিউরিটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক রব মজুমদার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চেয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব দেয়নি। তবে পৃথিবীর দেশে দেশে দেশটির সামরিক ঘাঁটি আছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের ঘাঁটি এ অঞ্চলে স্থাপন করতে চাইতে পারে। তবে সেন্টমার্টিনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাঁটি করা হলে তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের ভূখণ্ড টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপটি স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা বা দারুচিনি দ্বীপ হিসাবে পরিচিত। ২৫০ বছর আগে আরব নাবিকেরা প্রথম এ দ্বীপে বসবাস করেন। তারা এর নাম দেন জাজিরা। ব্রিটিশ শাসনের সময় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি।

কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে ওঠে। এর ১০০ বছরের মধ্যে উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময়ে বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। কিন্তু তার পরও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এর আগে ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে বর্মী রাজার যে যুদ্ধ হয়, তাতে বিতর্কের ইস্যুগুলোর মধ্যে এ দ্বীপের মালিকানাও ছিল অন্যতম। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন আট বর্গকিলোমিটারের মতো। এর সঙ্গে সংলগ্ন ছেড়া দ্বীপটি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল থেকে দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। ভাটির সময় দুটি দ্বীপ এক হলেও জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।

Pin It