দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের কাশ্মীর সীমান্তে পাল্টাপাল্টি আক্রমণে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
দুই সপ্তাহ আগে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় দেশটির সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪০ জনের বেশি জওয়ান নিহত হওয়ার থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল।
মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতের বিমান বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করলে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়।
ইসলামাবাদ এই আক্রমণের জবাব দেওয়ার হুমকি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা ধরে অন্তত ৫০টি স্থানে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের দিকে মর্টার শেল ছোড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা।
সীমান্তে সেনাদের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্যে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতারাও হুমকি-পাল্টা হুমকি চালিয়ে যাচ্ছেন।
পুলওয়ামা হামলার পর বলিউডে পাকিস্তানি শিল্পীদের বর্জনের ডাক দিয়েছিল ভারতের চলচ্চিত্র সংগঠনগুলো। মঙ্গলবারের বিমান হামলার পর পাল্টা পদক্ষেপে পাকিস্তানে ভারতের চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন বর্জনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন দেশটির তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী।
দুই দেশের এই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবের মধ্যে দুই পক্ষকেই শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মহল।
ভারতে সাধারণ নির্বাচনের আগে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির কাশ্মীর রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মেহবুবা সাধারণ মানুষের স্বার্থে রক্তপাত এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এক টুইটে তিনি বলেছেন, “মনে রাখতে হবে, সহিংসতা কেবল সহিংসতাই ডেকে আনে।”
তেমনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ভাইয়ের মেয়ে লেখক ফাতিমা ভুট্টো টুইট করেছেন শান্তির আশায়। তিনি লিখেছেন, “মানুষ যুদ্ধের জন্য শোর তুলবে, এর চেয়ে অসুন্দর আর কিছুই নেই। আমি ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের শান্তির জন্য প্রার্থনা করছি।”
ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান দেশ হিসেবে পথচলা শুরু করার পর থেকে শান্তির পথে কাঁটা হয়ে আছে কাশ্মীর। ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলটি নিয়ে দুই দেশ কয়েকবারই যুদ্ধে জড়ায়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে উত্তেজনা সৃষ্টির পর মাঝে পরিস্থিতি অনেকটা শান্তই ছিল। কিন্তু গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার পর নতুন করে শুরু হয় উত্তেজনা।
পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ ওই হামলার দায় স্বীকারের পর সংগঠনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নয়া দিল্লির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছিল।
কিন্তু তাতে ইসলামাবাদের কোনো সাড়া না পেয়ে মঙ্গলবার পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে সংগঠনটির আস্তানা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয় বলে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে এই অভিযানের কথা জানান।
তিনি বলেন, “বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদের সবচেয়ে বড় শিবিরে হামলা চালিয়েছে ভারত। এতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনারত বহু সন্ত্রাসী, প্রশিক্ষক, কমান্ডার ও জিহাদি ধ্বংস হয়েছে।”
বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৩টার দিকে ১২টি জঙ্গি জঙ্গি বিমান জইশ-ই-মোহাম্মদ, লস্কর-ই-তৈয়বা ও হিজবুল মুজাহিদিনের অবস্থান লক্ষ্য করে ১০০০ কেজি বোমাবর্ষণ করে।
নয়া দিল্লি দাবি করে, বালাকোটে চালানো বিমান হামলায় ‘প্রায় ৩০০ জঙ্গি’ নিহত হয়েছে।
পুলওয়ামা হামলার দায় স্বীকার করা এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি আরও হামলার ছক কষছিল বলে অভিযোগ ভারত সরকারের।
গোখলে বলেন, “ভারতের বিভিন্ন অংশে আরও আত্মঘাতী হামলার ছক কষছে জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং এই উদ্দেশ্যে আত্মঘাতী জিহাদিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্রে এমন খবর পেয়েছিলাম আমরা।
“জইশ-ই-মোহাম্মদ ও অন্যান্যরা বিশাল সন্ত্রাসী শিবির পরিচালনা করে যেগুলোতে যে কোনো সময় কয়েকশ জিহাদিকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে তারা, বহুবার এমন প্রমাণ দিয়ে পদক্ষেপ নিতে বলছিল ভারত। কিন্তু পাকিস্তান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল এবং তাই নেওয়া হয়েছে।”
হামলা ‘পুরোপুরি পরিকল্পনামাফিক’ হয়েছে এবং ‘শতভাগ সফল হয়েছে’ বলে ভারতের এনডিটিভিকে জানিয়েছে কয়েকটি সেনা সূত্র।
নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) অন্য পাশে ১৯ মিনিটের অভিযানে লেজারনিয়ন্ত্রিত বোমা নিক্ষেপ করে ‘সন্ত্রাসীদের লঞ্চ প্যাড’ ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে কয়েকটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএনআইকে জানায়।
এই হামলায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ভারতের দাবি প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, আকাশসীমা লঙ্ঘন করে চালানো এই কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দাবি, ভারতীয় সামরিক বিমান তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার পর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানের ‘তাড়া খেয়ে পালানোর’ আগে বালাকোটের কাছে ‘বোমা ফেলে’ গেছে, কিন্তু তাতে কেউ হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর এক টুইটে বলেন, মুজাফরাবাদ সেক্টর দিয়ে ভারতীয় বিমানগুলো অনুপ্রবেশ করেছিল।
মুজাফরাবাদ এলাকাটি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অংশ এবং বালাকোট শহরটি কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত।
বালাকোটের ওই জঙ্গি ঘাঁটিটির অবস্থান ঘন বনের ভিতরে পাহাড়ের ওপরে বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম। বেসামরিক এলাকাগুলো থেকে এই ঘাঁটিটি অনেক দূরে এবং হামলার সময় সেখানে কোনো বেসামরিক উপস্থিতি ছিল না বলে গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যেরভিত্তিতে দাবি করেছে ভারত সরকার।
ঘাঁটিটিতে হামলা চালাতে ভারতীয় জঙ্গিবিমানগুলো মাত্র দেড় মিনিট সময় ব্যয় করেছে বলে এনডিটিভিকে জানিয়েছে কয়েকটি সূত্র।
পাকিস্তানে এটি জইশের বৃহত্তম শিবির এবং জইশ প্রধান মাসুদ আজহারের শ্যালক ইউসুফ আজহার এটি পরিচালনা করতেন বলে খবর ভারতের গণমাধ্যমের।
গফুর বলেন, “আজ প্রধানমন্ত্রী (ইমরান খান) সবাইকে সম্ভাব্য সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ভারতের এখন আমাদের জবাবের অপেক্ষায় থাকার সময় এসেছে।”
তিনি বলেন, “ভারতের দাবি, তারা আমাদের আকাশে ২১ মিনিট অবস্থান করেছে এবং ৩৫০ জঙ্গিতে হত্যা করেছে।
“আমরা বড় বড় কথা বলতে চাই না। তবে তাদের বলছি, আবারও আমাদের আকাশে আসুন এবং ২১ মিনিট থেকে দেখান।”
পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দলের নেতা শাহবাজ শরিফ আরও কড়া ভাষায় হুমকি দিয়ে বলেছেন, “যদি ভারত যুদ্ধ করতে চায় তবে দিল্লিতে পাকিস্তানের পতাকা উড়বে।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন বলেও তিনি দাবি করেন।
ইসলামাবাদের এই হুমকির মধ্যেই বিকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অন্তত ৫০টি স্থানে মর্টার শেষ ছোড়ে ও গুলিবর্ষণ করে বলে খবর আসে।
এতে পাঁচজন ভারতীয় সেনা আহত হয়েছেন বলে দেশটির টেলিভিশন স্টেশন এনডিটিভি জানায়।
ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই বলছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বিকালে সীমান্তে বেসামরিক স্থাপনা ও মানুষকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালায়।