সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানাচ্ছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ ছাড়া প্রশাসনে রাজনীতিকরণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় পেশাগত উৎকর্ষে ব্যাপক ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানায় এই সংস্থা।
রোববার ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার: নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এসব কথা জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের মহাসচিব অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ। গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম।
প্রতিবেদনে শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত নীতিগুলো পর্যালোচনা এবং সেগুলোর চর্চার বিষয়ে গবেষণা করে জনপ্রশাসনে দক্ষ জনবল ও নিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতি নিশ্চিত করা, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ও অসন্তোষের ঝুঁকি নিরসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং সার্বিকভাবে জনস্বার্থে ৯ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
জনপ্রশাসনের নিয়োগ, পদোন্নতি, ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, শৃঙ্খলাজনিত বিষয়, মূল্যায়ন, প্রণোদনা, ই-গভর্ন্যান্সসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ প্রণোদনামূলক বিষয়ে অগ্রগতি দেখা গেছে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে উল্লেখ্য ক্ষেত্রে কৌশলের চর্চা শুরুই হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ না হওয়ায় প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুদ্ধাচার কৌশলের প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া এখনও সুদূরপরাহত রয়েছে।
সরকারি কর্মচারী আইনের কতিপয় মৌলিক ধারার সমালোচনা করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকারি চাকরি আইন নামটিই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনের নাম হওয়ার কথা ছিল জনপ্রশাসন আইন। তাই আইনটির নাম সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধিও সম্পূর্ণরূপে সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক। এই বিধিও বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া এই আইনের ৬.১ ধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্ত কর্তৃত্ব সরকারের কাছেই রাখা হয়েছে। যা ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ এই সাংবিধানিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
শুদ্ধাচার কৌশলে প্রশাসন ক্যাডার থেকে টেকনিক্যাল বিভাগের উচ্চপদে পদায়ন না করে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে পদোন্নতি; সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি, ১৯৭৯-কে শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে হালনাগাদ, সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট ডিজিটাল কাঠামো করে সে অনুযায়ী প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রদান নিশ্চিত করা; জনপ্রশাসনের ওপরের পদগুলোতে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিয়ে নিচের দিকের শূন্যপদ পূরণ; প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত স্কোর এবং দক্ষতার মূল্যায়ন-পূর্বক পদোন্নতি দেওয়ারও সুপারিশ করেছে টিআইবি।
টিআইবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে জাতীয় শুদ্ধাচারের কোনো কোনো কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ প্রণীত হওয়ার ছয় বছর পার হলেও এতে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে বার্ষিক কর্ম-মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়ন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়ন এই তিনটি কৌশলের চর্চা এখনও শুরুই হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের ফলে জনপ্রশাসনে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ২০ শতাংশ পদ খালি থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে।
পদোন্নতি ও পদায়নের অসঙ্গতি তুলে ধরে মহুয়া রউফ বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসনের উপসচিব বা এর ওপরের পদে শূন্যপদের অতিরিক্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনও হয়। অন্যদিকে, বিধিমালায় উল্লেখ না থাকার পরও প্রশাসনের পদোন্নতিতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কোন গোয়েন্দা সংস্থা কী বিষয়ে কখন কী প্রতিবেদন দিচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানার সুযোগ নেই।