তবুও ঢাকায় হাঁটুজল, দিনভর দুর্ভোগ

dhaka_water_block_samakal-5d28b1a4a8d7e

বছর দুই আগে সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যতই বৃষ্টি হোক, ঢাকায় আর হাঁটুজল হবে না। ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ সরকারি সংস্থাগুলো আশ্বাস দিয়েছিল, আগামী বর্ষা মৌসুমে আর জলাবদ্ধতা নয়। কিন্তু কোনো আশ্বাসই কাজে আসেনি। শুক্রবার দুপুরে দুই ঘণ্টায় ৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ডুবে যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। নিদারুণ দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।

জলাবদ্ধতা নিরসনে গত দুই বছরে যেসব এলাকায় ড্রেন সংস্কার করা হয়েছিল, দিনের পর দিন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে পাইপ বসানো হয়েছিল, সেখানেও জলাবদ্ধতা হয়েছে। খোঁড়াখুঁড়ির দুর্ভোগ সয়েও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাননি নগরবাসী। তবে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় অনেকে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

২০১৭ সালের ২৬ জুলাই ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। এরপর সমালোচনার মুখে ওয়াসা জানিয়েছিল পরের বছর থেকে অবস্থার উন্নতি হবে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে সংসদে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ‘কথা দিয়েছিলেন’ আগামীতে আর ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু ২০১৮ সালেও ছিল অভিন্ন চিত্র।

চলতি মাসের শুরু থেকেই বর্ষার মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশের ওপর। গত সপ্তাহ থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকায়ও চলছে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত। শুক্রবার দুপুরে শুরু হয় ভারি বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা, ২৪ ঘণ্টায় ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা, দুই ঘণ্টায় ৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তাতেই ঢাকার অলিগলি থেকে রাজপথ- সব জায়গায় জমে যায় হাঁটু সমান পানি।

ওয়াসার দাবি, ঘণ্টায় ২০ মিলিমিটার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থায়। কিন্তু বৃষ্টি থামার চার ঘণ্টা পর ট্যানারি মোড়, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার পথে ছিল হাঁটুপানি। গ্রিন রোডের ধানমণ্ডি-৭ অংশে গত বছর ড্রেন সংস্কার করে নতুন পাইপ বসানো হলেও, শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে সেখানে দেখা যায় থৈথৈ পানি।

সিদ্ধেশ্বরীতেও ছিল জলাবদ্ধতা। সেখানকার বাসিন্দা তাসনিম মহসিন মিশু ফেসবুকে রসিকতা করে লেখেন, ‘ঢাকা ওয়াসাকে প্রতি মাসে বিল দেওয়ার প্রতিদানস্বরূপ আমাদের সিদ্ধেশ্বরীবাসীকে লেক উপহার দিয়েছেন স্যার জীবাণুভূষণ।’ জেবেল আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, ‘জলাবদ্ধতার ছবি ফেসবুকে দেবেন না। ওয়াসা জানলে সুইমিং বিলও দিতে হবে।’ মুজাহিদ ফুয়াদ লিখেছেন, ‘সারা ঢাকা শহর টেমস নদী হয়ে গেছে। ঢাকা টু ইউরোপ ফ্লাইট ক্যানসেল করলাম। টেমস নদী দেখতে আমার আর ইউরোপ সফর হলো না।’

তবে সবচেয়ে ভোগান্তি ছিল মিরপুরে। মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পর ওই এলাকার রাস্তা ভাঙাচোরা। ঠিক করা হয়েছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। কিন্তু শুক্রবারের বৃষ্টিতে মিরপুরের প্রায় সব এলাকাতেই ছিল থৈথৈ পানি। শেওড়াপাড়ার সড়কে জমে যায় কোমর পর্যন্ত পানি। সেখান থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত এক প্রকার নদীতে রূপ নেয়।

পানির কারণে মিরপুরে বাস চলাচল পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টি থামার ঘণ্টা দুয়েক পর, বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে দেখা যায় মতিঝিল থেকে মিরপুর ১২ নম্বরগামী স্বাধীন পরিবহনের একটি বাস শেওড়াপাড়া ওভারব্রিজ থেকে ঘুরে মতিঝিলে ফিরে যায়। পানির কারণে সামনে এগোতে পারেনি। তবে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় যানজট তেমন ছিল না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ, সিদ্ধেশ্বরী, মহানগর প্রজেক্ট, ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, আসাদগেট সংলগ্ন আড়ংয়ের মার্কেটের সামনের সড়ক, কারওয়ান বাজার, মগবাজার, মধুবাগ, তেজগাঁও, বৃহত্তর মিরপুর, কালশিসহ বিভিন্ন এলকায় মূল সড়ক ছিল জলমগ্ন।

কল্যাণপুরের বাসিন্দা শামসুর রহমান বলেন, তিনি অফিসের কাজে টিএসসি যাচ্ছিলেন। মাঝখানে আসাদগেট, ধানমণ্ডি, কলাবাগান থেকে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কে পানি দেখেছেন। অনেক রাস্তায় এত পানি ছিল যে, প্রাইভেটকার চলাচল ব্যাহত হয়েছে।

মিরপুর-১২ নম্বর থেকে শিকড় পরিবহনের বাসে করে আসা এক যাত্রী বলেন, তাদের গাড়ি কাজীপাড়ায় এসে নষ্ট হয়ে যায়। পরে পেছনে অসংখ্য গাড়ির লাইন পড়ে যায়। এতে মিরপুর-১০ পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়।

অভিন্ন চিত্র ছিল পুরান ঢাকায়। অলিগলিতে বৃষ্টির পানি জমে তা পয়ঃনিষ্কাশন নালার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। আবর্জনা মিশ্রিত পানির কারণে রীতিমতো ঘরবন্দি হয়ে পড়েন বাসিন্দারা। কিছু কিছু এলাকার দোকান ও বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকে যায়।

দুপুরের টানা বৃষ্টিতে কাজী আলাউদ্দিন রোড থেকে শুরু করে নাজিরাবাজার মোড় পর্যন্ত কোমর পানি জমে যায়। আলু বাজার ও সিদ্দিক বাজারের বিভিন্ন গলিতে পানি জমে থাকে। এ ছাড়া বংশাল, সিক্কাটুলী, রাজার দেউড়ি, আরমানিটোলা, চকবাজার, সূত্রাপুরের বিভিন্ন এলাকার অলিগলি, কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজের পেছনের এলাকা, কাজী আবদুর রউফ রোড, কলতাবাজার, ধোলাইখাল, রামকৃষ্ণ মিশন রোড, কে এম দাস লেন, দয়াগঞ্জ এবং ওয়ারীর বিভিন্ন এলাকার সড়ক, অলিগলিতে পানি জমে যায়।

নাজিরাবাজার এলাকার এক বাসিন্দা নজিবুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগেই কাজী আলাউদ্দিন রোড থেকে নাজিরাবাজার পর্যন্ত রাস্তা খুঁড়ে মোটা পাইপ বসানো হয়। দীর্ঘদিন সড়ক বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন এলাকার লোকজন। তখন সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে এই এলাকায় আর বৃষ্টির পানি জমবে না। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতেই কোমর পানি হয়ে যাচ্ছে। বংশাল রোডের এক বাসিন্দা বলেন, পুরো এলাকার পয়ঃনিষ্কাশন নালাগুলো খোলা থাকায় বৃষ্টির পানিতে মনুষ্য বর্জ্য মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

সূত্রাপুরের কাজী আবদুর রউফ রোডে জমে যাওয়া বৃষ্টির পানিতে রিকশার পাদানি পর্যন্ত ডুবে যায়। এরপরও দুপুরের পর পর্যন্ত ওই এলাকার ঘরবন্দি মানুষের বাসা থেকে বের হতে রিকশার ওপরই নির্ভর করতে হয়।

বেহাল অবস্থা ছিল মগবাজারের। মগবাজার র‌্যাব-৩ ক্যাম্পের সামনের সড়কে শুক্রবার দুপুর হাঁটুর ওপরে পানি হয়ে যায়। যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিছু অটোরিকশা ও প্রাইভেটকার নষ্ট হয়ে পানিতে আটকা পড়ে। এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, প্রতি বছর রাস্তা ও ড্রেন মেরামত করা হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ১৫ মিনিট বৃষ্টি হলেই রাস্তাটি পানির নিচে তলিয়ে যায়।

Pin It