রাজধানীতে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। প্রতিটি হাটই এখন নানা জাতের, নানা রঙের পশুতে ঠাঁসা। হাটের নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায়ও রাখা হয়েছে পশু। ঈদুল আজহার দিন যতই এগিয়ে আসছে, হাটগুলোতেও ততই বাড়ছে ক্রেতা সমাগম।
শুক্রবার ছুটির দিনে সকাল থেকেই হাটগুলোতে ক্রেতার ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। হাটের ইজারাদাররা বলছেন, এ পর্যন্ত ছোট ও মাঝারি আকারের পশুই বিক্রি হয়েছে বেশি। এগুলোর দাম এক লাখ টাকার মধ্যে। বড় আকারের পশুগুলোর বেচা-বিক্রি শনিবার শুরু হবে। কারণ, অনেকেরই বাসাবাড়িতে পশু রাখার সুবন্দোবস্ত নেই। এ জন্য তারা আগেভাগে পশু কিনতে চান না। মূলত ঈদের এক-দু’দিন আগেই ক্রেতার ঢল নামে পশুর হাটে।তাদের মতে, শনিবার থেকে সেই ঢল শুরু হবে।
হাটে পশুরও কমতি নেই। দামও সহনীয়। তবে বড় আকারের দৃষ্টিনন্দন গরুগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে আকাশচুম্বী। বাহারি নামও দেওয়া হয়েছে এসব গরুর। বিক্রেতারা বলছেন, দামের অবস্থা বুঝে তারা প্রয়োজনে আরও পশু হাটে আনবেন। আরও অনেক পশু তারা বিভিন্ন স্থানে জড়ো করে রেখেছেন। দাম ভালো পেলে সেগুলো আনবেন। এ পর্যন্ত ক্রেতারা সন্তোষজনক দাম বলছেন না। এ জন্য ব্যাপারীরা উদ্বিগ্ন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে গাবতলী হাটে ১৭টি গরু এনেছেন হাবিবুর রহমান। এর মধ্যে চারটি বিক্রি হয়েছে। তিনি বলেন, বেচাকেনা মনে হয় ভালোই হবে। ক্রেতাও আসছেন। তবে কাঙ্ক্ষিত দাম দিতে চাইছেন না।
সাতক্ষীরার কলারোয়া থেকে আসা পশু ব্যাপারী ইসহাক ১৮টি গরু এনেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি আছে বিদেশি জাতের ফ্রিজিয়ান, ব্রাহমা, নেপালি। কয়েকটি আছে দেশি। তিনি বলেন, তার গরুগুলো নিজের খামারের। তার খামারে কোনো ওষুধের কারবার নেই।
ইসহাক জানান, ইতিমধ্যে দেশি জাতের কয়েকটি গরু বিক্রি করলেও বড় গরুগুলোর ক্রেতা পাচ্ছেন না। তিনি বিদেশি জাতের গরুগুলোর দাম হাঁকছেন ৪ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা। এগুলোর ওজন ৬ থেকে ১২ মণ হবে বলে জানান তিনি।
গাবতলী ও হাজারীবাগ পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, এসব হাটে আসা বেশিরভাগ পশুই আমদানি হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম-উত্তরাঞ্চল থেকে। এছাড়া আশপাশের কিছু খামারে লালনপালন করা পশুও উঠেছে। গাবতলী পশুর হাটে ওঠা দুম্বা ও উট শুক্রবার পর্যন্ত বিক্রি হয়নি বলে জানান হাটের পরিচালনা কমিটির সদস্য সানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, দুপুর পর্যন্ত শ’দুয়েক গরু ও শ’দুয়েক খাসি বিক্রি হয়েছে। খাসিগুলোর দাম ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। কয়েকটি গরু ছাড়া সবক’টিরই দাম ছিল লাখ টাকার নিচে।
গাবতলী হাটে দেখা গেছে, এখানে পর্যাপ্ত পশুর আমদানি আছে। হাটের পরিধিও বাড়ানো হয়েছে। আগে একটি হাসিলঘর থাকলেও এখন ডজনখানেক হাসিলঘর স্থাপন করা হয়েছে। হাটে প্রবেশ মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য একটি ক্যাম্প করা হয়েছে। পাশেই আছে মেডিকেল ক্যাম্প। মাইকিংয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাকে সচেতন করা হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবারের ভারি বর্ষণের কারণে হাটের ভেতরে কাদাপানি জমে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কমলাপুর পশুর হাটে সাড়ে ৩০ মণ ওজনের বাহাদুর ও ২৭ মণের বাহুবলী সবার দৃষ্টি কাড়ছে। বাহাদুরের দাম হাঁকা হচ্ছে ১৪ লাখ, বাহুবলীর ১৩ লাখ। ষাঁড় দুটিকে আনা হয়েছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ‘এফ অ্যান্ড এফ অ্যাগ্রো ফার্ম’ থেকে। ফার্মের মালিক ফিরোজ হাসান বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে গরু দুটির লালনপালন করেছেন। এই দামের চেয়ে লাখখানেক কম হলেও বিক্রি করবেন। এর বেশি কম হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
তিনি জানান, এবার তিনি ৪৭টি গরু বিক্রির প্রস্তুতি নেন। তবে খামারেই অর্ধেক বিক্রি হয়ে যায়। তার খামারের কোনো গরুই ৩ লাখ টাকার নিচে বিক্রি হয়নি।
শুক্রবার রাজধানীর হাটগুলোতে দেখা গেছে, ট্রাক বোঝাই করে পশু আসছে। ইজারাদারের লোকজন সেগুলো হাটে রাখার জায়গা করে দিচ্ছেন। বরিশাল থেকে বছিলা হাটে ২১টি গরু নিয়ে আসা মো. জালাল বলেন, এগুলো বিক্রি হলে আরও গরু আসবে। যাত্রাবাড়ী হাটে গিয়ে দেখা গেছে, কাজলা ও শনির আখড়ায় গরু রাখার জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। দনিয়াতেও গরু রাখা হয়েছে। এছাড়াও গোয়ালবাড়ি মোড়, রসুলপুর এলাকায়ও গরু রেখেছেন ব্যাপারীরা। আরও গরু আসবে বলে জানিয়েছেন তারা।
ইজারাদার ও গরু ব্যবসায়ীরা জানান, এবার হাটে পর্যাপ্ত পশু উঠেছে। দেশে প্রচুর পশু উৎপাদন হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বন্যার কারণে মানুষ পশু বিক্রি করে দিচ্ছেন। এছাড়া সামনে কোনো নির্বাচনও নেই। এদিকে ডেঙ্গু নিয়েও অনেকে আতঙ্কে আছেন। সব মিলিয়ে এবার পশুর দাম সহনীয়ই থাকবে।
রাজধানীর আফতাবনগর পশুর হাটও জমে উঠেছে। দুপুরের পর থেকে ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। বেচাবিক্রিও বেশ। কুষ্টিয়ার মিরপুর থেকে পান্না শেখ নিয়ে এসেছেন ছয়টি গরু। শুক্রবার ৩টার দিকে তিনি ৮৬ হাজার টাকায় একটি গরু বিক্রি করেন। অন্য গরুগুলোর দাম হাঁকিয়েছেন ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে ১৮টি গরু নিয়ে বৃহস্পতিবার হাটে এসেছেন হাফিজ। তিনি বলেন, প্রতিটি গরুর পেছনে দৈনিক আড়াইশ’ টাকা খরচ আছে। সে তুলনায় এবার দাম মোটামুটি কম। কুষ্টিয়ার অন্য এক ব্যবসায়ী তার লাল-সাদা রঙের গরুর দাম হাঁকিয়েছেন দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকা।
নাটোরের গুরুদাসপুর থেকে বিপুলসংখ্যক বিক্রেতা পশু এনেছেন এ হাটে। ওই এলাকার বিক্রেতা আমিরুল জানান, তার কাছে ১৮টি গরু আছে। দাম সর্বনিম্ন ৪০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
গরুর পাশাপাশি ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও দুম্বাও উঠেছে এ হাটে। তবে কোনো উট চোখে পড়েনি। নওগাঁ থেকে ২৫টি ছাগল নিয়ে আসা হান্নান ব্যাপারী জানান, বুধবার তিনি হাটে এসে পৌঁছান। এখন পর্যন্ত ৯টি ছাগল বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ভেড়াও নিয়ে এসেছেন তিনি। দাম আট হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা।
একাধিক হাট যাচাই করে পছন্দের পশুটি বাছাই করছেন মালিবাগের বাসিন্দা আবদুল্লাহ। তিনি মাঝারি আকারের কালো রঙের একটি ষাঁড় কেনেন ৭৩ হাজার টাকায়। এ হাটে পশুর হাসিল ধরা হয়েছে শতকরা ৫ ভাগ। হাটের ইজারাদার নবীন হোসেন রনি বলেন, শুক্রবার বিকেলে ক্রেতার চাপ অনেক বেড়ে যায়। সব ধরনের ক্রেতাই আসছেন। স্থানীয় সাংসদ এ কে এম রহমত উল্লাহও গরু কিনতে এসেছিলেন। তাকে দেখে বিক্রেতারা বেশি দাম চাওয়া শুরু করেন। তাই তাৎক্ষণিকভাবে গরু না কিনে ফিরে যান। তবে কয়েকটি গরু পছন্দ করে গেছেন। তার লোকজন দরদাম করে পরে কিনবেন।
এদিকে উত্তরা পশুর হাটেও বাড়ছে ক্রেতা সমাগম। শুক্রবার রাজধানীর উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ী খালপাড় হাটে কথা হয় শেরপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী শাহিনুর ইসলাম। তিনি বলেন, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে নিজের পোষা ৬টির পাশাপাশি এলাকা থেকে আরও ৯টি কিনে মোট ১৫টি গরু ট্রাকে করে গত বুধবার ঢাকার এ হাটে আসেন। ট্রাক ভাড়া পড়েছে ১৯ হাজার টাকা। তবে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত তার কোনো গরু বিক্রি হয়নি।
তিনি বলেন, প্রতিটি গরুর দাম লাখ টাকার বেশি হলেও ক্রেতারা দাম বলছেন ৮০-৯০ হাজার টাকা। ক্রেতার সংখ্যাও কম।
শাহিনুর আরও বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজের পর ক্রেতার উপস্থিতি বাড়তে থাকায় গরুর দামও বাড়ছে। তিনি বলেন, ইজারাদার ব্যবসায়ীদের থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা না করায় এ হাটের পশু ব্যবসায়ীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
হাটের অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ইজারাদার নুর হোসেন এবং পরিচালক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশেনের কাউন্সিলর সফিকুল ইসলামের কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাদের একজন পকেটে পিস্তল ঢুকিয়ে পরিচয় না দিয়ে বলেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে তারা হাটের বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না। কারণ তারা হাট সম্পর্কে খারাপ নিউজ ছেপেছে।
রাজধানীর বাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা আব্বাস আলী এ হাট থেকে একটি দেশি গরু কেনেন। ৫ থেকে সাড়ে ৫ মণ ওজনের ওই গরুর দাম ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পড়েছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও জানান, হাট ইজারাদারের লোকজন শতকরা ৫ টাকা হিসাবে হাসিল আদায় করছে।
এখানকার ৪ নম্বর হাসিল কাউন্টারের ম্যানেজার পানা উল্লাহ জানান, এ বছর গরুর দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে। গত ২ দিন এ হাটে তেমন একটা বিক্রি হয়নি। শুক্রবার জুমার নামাজের পর জমে উঠেছে পশু বিক্রি।
ফরিদপুর থেকে গরু নিয়ে আসা ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, উত্তরার এ হাটে প্রায় ৫ লাখের বেশি গরু উঠেছে। তার রয়েছে ১৯টি গরু। প্রতিটি গরুর দাম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। তবে ক্রেতারা প্রতিটি গরুর দাম বলছেন ২ লাখ টাকার ওপরে।
টাঙ্গাইল থেকে ছাগল নিয়ে আসা ব্যবসায়ী কালাম বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার ছাগলের দাম একটু বেশি। তার ২০টি ছাগলের মধ্যে ৫টি বিক্রি হয়েছে। ১৫ থেকে ১৮ কেজি ওজনের একেকটি ছাগল বিক্রি করেছেন ১৮ থেকে ১৯ হাজার টাকায়।