ফিল্ডিংয়ে দু-একটি বাজে দিন আসা অস্বাভাবিক নয়। তবে বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে পরের শ্রীলঙ্কা সফরে, বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়ে বাজে দিনই ছিল বেশি, ভালো দিন কম। ফিল্ডিং কোচের চাকরিও সুতোয় ঝুলছিল। শেষ পর্যন্ত যদিও টিকে গেছেন। নতুন মৌসুম শুরুর আগে কন্ডিশনিং ক্যাম্পে চলছে ফিল্ডিং অনুশীলনও। শনিবার অনুশীলন শেষে ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক কথা বললেন দলের সাম্প্রতিক ফিল্ডিংয়ের অবস্থা, ভবিষ্যৎ ভাবনা, দেশের ফিল্ডিং সংস্কৃতিসহ আরও অনেক দিক নিয়ে…
বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে পরে শ্রীলঙ্কা সিরিজেও ফিল্ডিং বাজে হয়েছে বাংলাদেশ দলের। ফিল্ডিংয়ের দুরাবস্থা কাটিয়ে ওঠার উপায় কি?
রায়ান কুক: প্রতিদিনই উন্নতি করতে হবে আমাদের। ফিল্ডিংয়ের অনেক মৌলিক দিক ভুল করে ফেলছে ছেলেরা। আমরা চেষ্টা করছি, যতটা সম্ভব সেসব শুধরে নিতে। বিশ্বকাপে আমাদের কিছু খুব ভালো ম্যাচও গিয়েছে। কিছু ম্যাচে ফিল্ডিং ভালো হয়নি। ক্যাচ পড়েছে। ছেলেরা সেসব জানে। আমরা চেষ্টা করছি সবদিকে উন্নতি করার।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ক্যাচ পড়েছে। সহজ ক্যাচ পড়েছে নিয়মিত…
কুক: ক্যাচিং একটু অধারাবাহিক, এটা সত্যি। বিশ্বকাপে খুব ভালো কিছু ক্যাচও আমরা নিয়েছি। এমনকি শ্রীলঙ্কা সিরিজেও। কিন্তু ক্যাচিংয়ে অবশ্যই ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। আরও অনেক বেশি ধারাবাহিক হতে হবে। আগামী কয়েক দিনে এদিকে জোর দেব আমরা।
মৌলিক ব্যাপারগুলো কি বয়সভিত্তিক পর্যায়েই ঠিক করার কথা নয়?
কুক: কোনো ক্রিকেটার যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, সেখান থেকে উন্নতি করতে পারে। অনূর্ধ্ব-১৫ পর্যায় বলুন বা যেটাই বলুন, এটি সবার জন্যই সত্যি। তবে কখনও কখনও প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন থাকে। যেমন ইবাদত (হোসেন), বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে যে খুব একটা খেলেনি, সে কোন অবস্থায় আছে, এটা বোঝা একটু কঠিন। তবে হ্যাঁ, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের শুরুর ধাপ থেকেই ফিল্ডিংয়ে বাড়তি জোর দেওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে মৌলিক দিক নিয়ে কাজ করতে হলে ফিল্ডিং কোচের জন্য তা কতটা কঠিন?
কুক: অবশ্যই সহজ নয়। তবে সব কোচকেই কিছু না কিছু এই কাজ করতে হয়, ব্যাটিং কোচ হোক বা বোলিং কোচ। বেসিকই তো মূল ব্যাপার, যা ম্যাচ জেতায়। সেদিক থেকে কাজটা অবশ্যই কঠিন। তবে সেটাই তো আমাদেরকে করতে হবে।
মৌলিক ব্যাপারগুলো ঠিক করতে কিন্তু সময় লাগে। রাতারাতি হয় না। মৌলিক দিক ঠিক করতে লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হয়। ক্রিকেটারদের কেউ কেউ নিজেদের ফিল্ডিংয়ের কিছু জায়গায় উন্নতিতে ভালো অগ্রগতির ছাপ রেখেছে। আমি চেষ্টা করছি ওদের মানকে এক পর্যায় থেকে আরেকটি পর্যায়ে নিতে।
কুক: আমি বলব, আপাতত মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। বিশ্বকাপে নিরপেক্ষ কন্ডিশনে নিজেদের যাচাই করার সুযোগ ছিল আমাদের। আমরা বুঝতে পেরেছি, এখন হয়তো আমরা মাঝামাঝি দিকে আছি। আমি আমাদেরকে দেখতে চাই সেরা তিনে। এবং আমি মনে করি, ফিল্ডিংয়ে সেরা তিনে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে।
সেজন্য কোন দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে আমাদের?
কুক: আমার মনে হয়, সবদিকেই। বিশ্বকাপের আগেও আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। কারণ সুযোগ কাজে লাগানো ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি থ্রোয়ে রান আউটের দিকে আমরা মনোযোগ দিয়েছিলাম, সেটি কিন্তু বিশ্বকাপে বেশ ভালো হয়েছিল। অন্য কয়েকটি দলের তুলনায় আমাদের ক্যাচিংয়ের হারও ভালো ছিল। মনোযোগ দিয়েছিলাম বলেই সম্ভব হয়েছিল।
বিশ্বকাপের পর কি ফিল্ডিং নিয়ে নিশ্চয়ই প্রতিবেদন দিয়েছিলেন বিসিবি। সেখানে মূল কথা কি ছিল, সেসব কি কিছুটা বলা যায়?
কুক: হ্যাঁ, বিশ্বকাপ শেষে প্রতিবেদন দিয়েছি। সব সিরিজ শেষেই দিয়ে আসছি। এসব প্রতিবেদনে আসলে অনেক বিশদ ব্যাপার আছে। আলাদা আলাদা করে ম্যাচে আমরা কেমন করলাম, কত রান বাঁচালাম, এসব।
একটা দিকে আমরা জোর দিয়েছিলাম, কোনো ক্রিকেটারের শক্তির জায়গা বুঝে তাকে সেই পজিশনে ফিল্ডিংয়ে দাঁড় করানো। বিশ্বকাপে এটির দিকে অনেক মনোযোগ ছিল আমাদের। শ্রীলঙ্কাতেও সত্যি বলতে বেশ ভালো করেছি আমরা। প্রতিবেদনে এসবই ছিল।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়ে মূল ঘাটতির জায়গা কোথায়?
কুক: দেখুন, এটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। একদম তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত ফিল্ডিংকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্রিকেটারদেরকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, বাংলাদেশের সেরা তো বটেই, আমি বিশ্বের সেরা ফিল্ডার হতে চাই। এবং সেটা অর্জন করতে একটা সিস্টেম থাকতে হবে, যা বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে কার্যকর হবে।
যেমন, একটি দিক বলতে পারি, ফাস্ট বোলারদের ক্ষেত্রে এখন আর ব্যাপারটি এমন নেই যে তাদেরকে বাউন্ডারিতেই থাকতে হবে। তাদেরকেও ফিল্ডিংয়ের অনেক কিছু শিখতে হবে। এই দিকটায় আমরা অনেক জোর দিতে পারি।
কুক: অবশ্যই। এই দুটির সম্পর্ক খুব কাছাকাছি। যারা বেশি প্রাণবন্ত, গতিময়, তারা অবশ্যই বেশি ভালো ফিল্ডার। আগেও আমরা এসব নিয়ে কথা বলেছি। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে কিছু কাজ করেছি আমি। সেখানে দেখেছি, থ্রোয়িংকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে নেয় তারা। তাদের সিস্টেমে অনূর্ধ্ব-৯ পর্যায় থেকে আস্তে আস্তে সব পর্যায়েই টেকনিকগুলো শেখায়। সেজন্যই তারা এমন সব ফিল্ডার পায়, যারা মাঠের যে কোনো জায়গা থেকে থ্রো করতে পারে দারুণভাবে। আমরা সেই পর্যায়ে নেই। সেটাই নিশ্চিত করতে হবে যেন আমরা সেই পর্যায়ে যেতে পারি।
চাপে ভেঙে পড়াও কি একটা ব্যাপার? চাপের সময় ফিল্ডিংয়ে অনেক ভুল করতে দেখা যায়…
কুক: চাপের সময় ব্যাপারটা আপনাকে এভাবে দেখতে হবে যে…আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিটি মুহূর্তই চাপের। অনেক সময় এমনটি হয় যে, চাপের সময় কোনো একটা কিছু ঠিকমতো না হলে, সেটি নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। কিন্তু চাপের সময় আমরা ভালো করি, এমন অসংখ্য উদাহরণও আছে!
সেদিক থেকে বলা যায়, চাপের সময় বা চাপ ছাড়া সময় বলে কিছু নেই। একটি ওয়ানডে ম্যাচে হয়তো ৩০০ মুহূর্ত আছে, টেস্টে আরও অনেক বেশি। ব্যাপারটি হলো, ছেলেরা যাতে মৌলিক ব্যাপারগুলো না ভুলে যায়। কারণ, চাপের সময় টেকনিক বা ট্যাকটিকস নিয়ে বেশি ভাবলে উল্টো ফল হতে পারে। তখন কেবল ওই মুহূর্তটায় মন দিতে হবে। এই জায়গাগুলোয় আমাদের উন্নতি করতে হবে।
ফিল্ডিংয়ে প্রতিটি সংস্করণে বাংলাদেশকে আলাদা করে নম্বর দিতে বললে, দশে কত দেবেন?
কুক: টি-টোয়েন্টিতে হয়তো দশে সাড়ে ছয় দেব, ওয়ানডেতে সাড়ে সাত এবং টেস্টে সাত। তার মানে আমাদের উন্নতির এখনও অনেক জায়গা আছে। তবে অনেক জায়গায় আমরা ভালোও করছি।
কুক: আগে তো স্কোয়াডটা ঠিক করতে হবে আমাদের। তার পর দেখতে হবে স্লিপে দাঁড়ানোর মতো কে আছে। যারা এই পজিশনে দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে যোগ্য, তারাই দাঁড়াবে।
টেস্টে স্লিপ ক্যাচিং বরাবরই বাংলাদেশের বড় দুর্ভাবনার জায়গা। সামনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হচ্ছে। এখানে উন্নতিতে আপনার ভাবনা কি?
কুক: এই জায়গাটিতে আমাদের অনেক জোর দিতে হবে। কারণ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আসছে। বিশেষ করে, দেশের বাইরের ম্যাচগুলির জন্য।
স্লিপ ক্যাচিংয়ের বড় একটি ব্যাপার নির্ভর করে আসলে দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির ওপর, বেড়ে ওঠার সময় তারা যা করে আসে। দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়তো অনূর্ধ্ব-১২ পর্যায়ের ম্যাচেও ৫টি স্লিপ দেখা যায়। তারা তাই ছেলেবেলা থেকেই অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে মন্থর ও নীচু উইকেটে এসব দেখা যায় না। স্লিপে খুব বেশি বলই যায় না।
আমরা চেষ্টা করছি কাজ করে এখানে উন্নতি করার। কাজ চলতে থাকবে। আমাদেরকে স্লিপের জন্য কিছু ফিল্ডার বের করতে হবে, তখন কাজ সহজ হয়ে যাবে।
স্লিপ ফিল্ডিং কিন্তু কেবল একজনের ব্যাপার নয়। স্লিপ কর্ডন নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্ব ক্রিকেটে স্লিপ ক্যাচিংয়ে যারা সেরা দল, তাদের দেখবেন, লম্বা সময় ধরে একই ফিল্ডাররা স্লিপে ফিল্ডিং করে আসছে। স্লিপেও জুটির ব্যাপারটি কাজ করে। কে কোন ক্যাচ নেবে, এসব ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর অনেক আস্থা, বিশ্বাস থাকতে হয় স্লিপ ফিল্ডারদের। আমাদেরও এই ব্যাপারগুলি গড়ে তুলতে হবে।