করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত বিশ্ব থেকে যতটা না সুসংবাদ আসছে তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে দুঃসংবাদ। একটি দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমছে, তো বাড়ছে কয়েকটি দেশে। ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা শেষ পর্যন্ত বাড়ছেই। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখের বেশি মানুষ। আর এই সময়ে মারা গেছেন রেকর্ডসংখ্যক ৭ হাজারের বেশি লোক। তবে তার পরের ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে। রোববার বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৮৪ হাজার আর মারা গেছেন ৫ হাজার ৩০০ জন। করোনায় লণ্ডভণ্ড স্পেন ও ইতালিতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দিন দিন কমে এলেও বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে। ইরানে রোববার আবার সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। সংক্রমণ বেড়েছে চীনেও। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ও মৃত্যুর লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী। নিউইয়র্ক রাজ্যে শনিবার এক দিনেই মারা গেছেন ৬৩০ জন। এ রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা পুরো এশিয়া মহাদেশে শনাক্তের সংখ্যার কাছাকাছি। মৃত্যুও এশিয়া থেকে মাত্র ৬শ’র মতো কম মাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের অবনতিশীল পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই সপ্তাহ ও আগামী সপ্তাহের মধ্যের সময়টি সবচেয়ে কঠিন সময় হতে পারে আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সময় অনেক মৃত্যু হতে পারে।’ নিউইয়র্কে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ৫৬৫ আর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজারের বেশি। আগামী চার থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রাজ্যটিতে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে বলে গভর্নর কুমো জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হিসাবে নিউইয়র্ক রাজ্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থা থেকে সপ্তাহখানেক দূরে আছে।
করোনায় রোববার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মারা গেছেন ৮ হাজার ৪৬৮ জন। হোয়াইট হাউসের মেডিকেল বিশেষজ্ঞরা কভিড-১৯ মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন। দেশব্যাপী ঘরবন্দি নির্দেশনা থাকার পরও এত লোকের মৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সার্বক্ষণিক হিসাব রাখা ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, শনিবার রাত ৯টা পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১২ লাখ ২৫ হাজার ৭৭২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬৪ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মারা গেছেন ৬৬ হাজার ৫২২ জন। রোববার পর্যন্ত করোনায় ইউরোপে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। মারা গেছেন ৪৭ হাজারের বেশি লোক। এশিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ১৭ হাজারের বেশি লোক এবং মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪২০০ জনের।
স্পেন মৃত্যুর চূড়ায় পৌঁছার পর এখানে কমতে শুরু করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। রোববার দেশটিতে মারা গেছেন ৬৭৪ জন। শনিবারের চেয়ে মৃত্যু কমেছে ১৩৫ জন। দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। রোববার পর্যন্ত দেশটিতে মারা গেছেন ১২ হাজার ৪১৮ জন আর আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৯ জন। ফ্রান্সে শনিবার ৪৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের দিন মারা যান ৫৮৮ জন। দেশটিতে মোট মারা গেছেন ৭৫৬০ জন আর আক্রান্তের সংখ্যা ২৮ হাজার ১৪৩। তবে দেশটিতে বাড়ি বসে যারা মারা গেছেন তাদের অনেকের নাম মৃত্যু তালিকায় নেই।
ইতালিতে শনিবার মারা গেছেন ৬৮১ জন। আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ২৪ হাজার ৬৩২ জনে পৌঁছেছে। মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৩৬২ জনের। যুক্তরাজ্যেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। রোববার পর্যন্ত দেশটিতে মারা গেছেন চার হাজার ৯৩২ জন। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪৮ হাজার। যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, সেখানে সাত হাজার থেকে ২০ হাজার লোক মারা যেতে পারে।
ইরানে রোববার মারা গেছেন ১৫০ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার ৬০৩ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৮ হাজার ২২৬ জনে। করোনায় তুরস্কে শনিবার পর্যন্ত মৃত্যু ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৪ হাজার মানুষ। শনিবার একদিনেই মারা গেছেন ৭৬ জন। চীনের মূল ভূখণ্ডে সংক্রমণের হার রোববার বেড়েছে। এদিন আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে ১৯ জন বেড়ে ৩০-এ পৌঁছেছে। চীনে রোববার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ৬৬৯ এবং মারা গেছেন তিন হাজার ৩২৯ জন। তবে চীনের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা পশ্চিমা সরকারগুলো বিশ্বাস করছে না।
সিঙ্গাপুরে রোববার রেকর্ডসংখ্যক ১২০ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৭৯ জন বেড়ে তিন হাজর ৬৬২ জনে পৌঁছেছে। জাপানের রাজধানী টোকিওতে একদিনে সর্বোচ্চ ১৩০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কাতারে একদিনে ২৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ক্ষুদ্র দেশটিতে মোট আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ২১৩ জন।
ব্রাজিলের কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্ট জেইল বলসোনারো করোনাভাইরাসের হুমকিকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করলেও দেশটির সাও পাওলোর বৃহত্তম গোরস্তানে গণকবর খোঁড়া হচ্ছে। দেশটিতে মারা গেছেন ৩২৯ জন। করোনাভাইরাসে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ ঘণ্টায় ৫০৫ জন বেড়ে তিন হাজার ৫৭৭ জনে পৌঁছেছে। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৮০-তে। করোনাভাইরাসে ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ জন এবং যুক্তরাজ্যে সাত চিকিৎসক মারা গেছেন।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের সবচেয়ে জনবহুল শহর গুয়াইয়াকিলের রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে আছে বলে খবর পাওয়া যচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে উপচেপড়া রোগী ও মৃতদেহের কারণে শহরটির সরকারি সেবা বিভাগগুলো প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে অসুস্থ রোগী ভর্তি করার মতো শয্যা অবশিষ্ট নেই। রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকার তথ্য সামনে আসার পর দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট অটো সোনেনহোলৎজার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
অনুসরণীয় মানবিকতা : স্পেনে লকডাউন জারির পর রাজধানী মাদ্রিদের একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট খালি হয়ে যায়। পরে সেটির মালিক সেখানে ভেনিজুয়েলার শরণার্থীদের আশ্রয় দেন। রাজনৈতিক দাঙ্গা থেকে বাঁচতে ভেনিজুয়েলার বহু নাগরিক স্পেনে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। লা সিগুয়েনা নামের রিসোর্টের মালিক সেখানে ১২টি শরণার্থী পরিবারের ৬৫ জনকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করে যাচ্ছেন।
চেক প্রজাতন্ত্রের তিন শতাধিক পাইলট তাদের ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। তারা দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। বিমানের জ্বালানি খরচও তারাই বহন করছেন। সরকারকে সহায়তার জন্য পাইলট টু দ্য পিপল নামের একটি প্রকল্পের অধীনে কাজ করছেন তারা। সূত্র :বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপি, রয়টার্স ও এনডিটিভি।