পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী দুই সপ্তাহের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে কর্মরতদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে শনাক্ত হলেই আইসোলেশনে রাখতে হবে ।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের জারি করা লকডাউন মানছেন না কেউই। এ কারণে দেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ব্যাপক হারে বাড়ছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশেও এই মুহূর্তে মানুষকে ঘরে রাখা খুবই জরুরি। কিন্তু এক্ষেত্রে সফলতা আসছে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখের সামনে দিয়ে প্রতিদিনই ঢাকায় প্রবেশ ও বের হচ্ছেন অনেকে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে রাস্তাঘাট, বাজার, পার্ক ও চায়ের দোকানে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন যুবকেরা। সাধারণ ছুটি বাড়লেও দিন যত গড়াচ্ছে, রাস্তায় সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যা তত বাড়ছে। এছাড়া পণ্য পরিবহনে যাত্রী বহন করা হচ্ছে।
এমন অবস্থার মধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী দুই সপ্তাহ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সাব-সেন্টার রয়েছে। আর ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব সাব-সেন্টার ও হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরতদের সীমিত আকারে প্রশিক্ষণ দিয়ে সারাদেশে বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলায় ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হবে। যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হবেন তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। এই ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমেই করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ‘করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি দীর্ঘদিন থাকতে পারে। সহসাই যাবে না। তাই প্রত্যেক দেশকে সতর্ক থাকতে হবে। কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায়ই হিমশিম খাওয়ার উপক্রম। আর যদি সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে তাহলে দেশের অবস্থা হবে ভয়াবহ। এক জন চিকিত্সক করোনায় আক্রান্ত হলে এক মাস আগে সুস্থ হচ্ছেন না। তাহলে ব্যাপকসংখ্যক চিকিত্সক যখন আক্রান্ত হবেন, তখন চিকিত্সা দেওয়ার লোকই থাকবে না। আমেরিকার মতো দেশ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের বিস্তারের প্রেক্ষাপটে সারা বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে দেশের সব জেলায় এখনো করোনার সংক্রমণ ঘটেনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৫৮ জেলায় করোনার সংক্রমণের তথ্য জানিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া জেলাগুলোর অধিকাংশই লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সরকার ২৬ মার্চ থেকে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ছুটি ঘোষণা করে। এর আগে স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সারাদেশে এখনো ছুটি চলছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলছে লকডাউন। দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে লকডাউনের পরিসর। কিন্তু মানুষকে ঘরে রাখা যায়নি। পরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় সুরক্ষার ব্যাপারটিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঘোষিত লকডাউন মেনে চলার ব্যাপারে মানুষের সমর্থন থাকলেও কার্যত তা মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়ছে সচেতন মহলেই। এ কারণে বিপদ বাড়ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশে প্রথম দিকে আক্রান্তের সংখ্যা কম থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। লকডাউন কার্যকর করা যায়নি। এ কারণে এখন আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব বলেও জানান তিনি।
দেশব্যাপী সংক্রমিতদের শনাক্তকরণে দুই সপ্তাহের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এ প্রোগ্রামের আওতায় আক্রান্তদের শনাক্তকরণে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে দেবেন।
এ ব্যবস্থায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। অন্যথায় কোনো ব্যবস্থায় কোনো ফলাফল আসবে না। পরিস্থিতি আরো দ্রুত অবনতির দিকে আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, যেহেতু করোনা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিকারই উত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু আমরা সচেতন নই। নিয়ম না মানার প্রবণতা বেশি। তাই প্রতিকার-প্রতিরোধ ব্যবস্থা সফল হচ্ছে না। এ মুহূর্তে রোগ যেন না ছড়ায় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। নইলে জাতিকে বড়ো ধরনের খেসারত দিতে হবে।
তিনি বলেন, জাতি নিয়ম মানতে চায় না। সরকার কয়েক দফা ছুটি ঘোষণা করেছে। তার পরও মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। তাই এখন দুই থেকে তিন সপ্তাহ ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় শনাক্তকরণ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। আর যত বেশি শনাক্ত করা যাবে, রোগীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার মাধ্যমে করোনা তত বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। গতকাল পর্যন্ত ২১৫ জন ডাক্তার, ৬৬ জন নার্স ও ১৮৮ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৪৬৯ জন করোনায়া আক্রান্ত হয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে করোনা আক্রান্তদের চিকিত্সা দেওয়ার জন্য সেবাকর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে করোনা শনাক্তকরণে দেশব্যাপী দুই সপ্তাহের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা জরুরি বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রয়োজনে আট থেকে ১০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনোলজিস্ট চাকরির অপেক্ষায় রয়েছেন তাদের মধ্যে কয়েক হাজারকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠানো যেতে পারে। এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনোলজিস্টরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠাবেন। শনাক্তদের নিজ বাড়িতে রেখেই চিকিত্সা দেওয়া সম্ভব। তাহলে করোনা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।