করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় বিল গেটস, জ্যাক মা, শাহরুখ খান ও আমির খানদের অনুদানের তথ্য তুলে ধরে দেশের সম্পদশালীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে ‘করোনা: শ্রমজীবীদের চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে এক গোলটেবিল আলোচনায় চলমান সংকট মোকাবেলায় সরকার ‘ব্যর্থ হয়েছে’ দাবি করে তাদেরও সমালোচনা করেন মান্না।
‘কিছু দিনের মধ্যে’ বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক।
এই সংকটকালে দেশের বিত্তবানদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এক বিল গেটস দিয়েছেন ৪৪ বিলিয়ন ডলার, হেল্প করেছেন। চীনের জ্যাক মা ৪০ বিলিয়ন, ভারতের শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান দিয়েছেন ২০০ কোটির উপরে।
“আমাদের দেশের বড় লোকরাই সব ফকির, কেউ কোনো টাকা দিতে পারে নাই। কী কারণে, বলেন তো? আমাদের দেশের লক্ষ-কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়, কিন্তু টাকা দিতে পারে নাই কেউ।”
সংকটের চিত্র তুলে ধরে মান্না বলেন, “গার্মেন্ট শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছে না। এখন তো শুধু আমরা শ্রমিকদের কথা বলছি। যারা নিম্নবিত্ত তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবে, যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবে। এটা কত দূর কন্টিনিউ করবে কিছু জানি না।
“কত বড় যে সংকট, আমাদের যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের মাথায় এগুলো কিচ্ছু নাই। মানে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করা মুশকিল।”
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “চার কোটি পরিবার আছে যারা দিনে আনে দিন খায়, ওরা দুই মাস বেঁচে আছে কেমনে আমি তাই ভেবে বুঝতে পারি না। মারা যাবে লোক, দুর্ভিক্ষের লাশের সারি দেখবেন রাস্তার মধ্যে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যদি আপনি এখনই কিছু না করতে পারেন।”
এই সংকট মোকাবেলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য সব পেশাজীবী সংগঠনকে এক হয়ে ‘একটা কিছু করার’ আহ্বান জানান মান্না।
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আজকের ডেইলি স্টারে আছে, এক আওয়ামী লীগের নেতা উনি জেলার কি যেন সম্পাদক, উনি রেড ক্রিসেন্টের সম্পাদক, হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, আরও কয়েক জায়গায় আছেন- তার এক পরিবারের ১৩ জন ওএমএসর চাল পেয়েছে। এই ১৩ জনের মধ্যে ৪-৫ জন নাকি বিদেশে থাকে। আর অনলাইন নিউজপেপার দিয়েছে তিন দিন আগেই- একটা লোকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
“কার কাছে কী বলবেন? মানে আমরা এত অসহায়, এতই আমাদের হাত-পা বাঁধা। এই রকম একটা সিন্দাবাদের ভুত আমাদের কাঁধে। আপনি কাঁধ যতই নাড়া-চড়া করেন, মাটিতে গড়াগড়ি খান ও নামবে না, থাকবেই এবং কোনো কাজ করবে না, আপনার ঘাড় চাপতে থাকবে, চাপতে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে কোনো টাকা পয়সা পাওয়া যায় কি না, না হলে চালটা পাওয়া যায় কি না-পানির নিচে রাখবে, মাটির নিচে রাখবে সেই চালের উপরে রাখবে- এই রকম একটা দুঃশাসন আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে।”
এই সংকট মোকাবেলায় সবাইকে নিয়ে একটি ‘কারিগরি কমিটি’ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান মাহমুদুর রহমান মান্না।
“শ্রমিকদের দাবি মেনে নিন।এই সরকারের সমস্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমরা সবাই যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারি নিশ্চয়ই উই উইল সারভাইভ,” বলেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “কথা একটিই- সরকারকে তার ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে হবে, এই ব্যর্থতা স্বীকার করে অবিলম্বে বিভিন্ন সংগঠন, বিশেষজ্ঞ তাদেরকে নিয়ে একটি জাতীয় সমন্বয়ক কমিটি গঠন করতে হবে।
“এই জাতীয় সমন্বয় কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হবে এই ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংকট থেকে আমরা কীভাবে বাঁচতে পারি এবং কীভাবে আমাদের শ্রমিকদের বাঁচাতে পারি।’’
শ্রমিকদের দুই-চার বেলা খাবার দিয়ে ‘কিছু হবে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদের জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের রক্ষায় মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে। ৪০ বছর গার্মেন্ট মালিকরা ব্যবসা করেছেন, কোথায় তাদের টাকা?”
খন্দকার মাহবুব বলেন, “আমি দিব্যি চোখে দেখছি যে, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তার চেয়েও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে আসবে, মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। যে প্রণোদনা আপনারা দিয়েছেন তা সত্যিকার অর্থে মানুষ পাচ্ছে না। তারা বাধ্য হবে রাস্তায় নামতে।
“তার ফলে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমরা চাই না যে, এই অরাজক পরিস্থিতি হোক। তাহলে আমরা কেউ মুক্তি পাব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার শুভ কামনা করব। আপনি একক দায়িত্ব নিয়েন না। এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। এই মুহূর্তে অহমিকা বাদ দিন, অহংকার বাদ দিন একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করেন।”
সভাপতির বক্তব্যে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, “খুব বেশি দূরে নয়, আমাদের শ্রমজীবীদের সকলকে একদিন এক হয়ে দাঁড়াতে হবে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
“বর্তমান সরকার মালিকদের সরকার। গার্মেন্ট মালিক, সংবাদপত্রের মালিক, দোকান মালিক সব মালিকরা হচ্ছে সরকারের সঙ্গে। টিপু মুনশি গার্মেন্ট মালিক, উনি হচ্ছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। সব মালিকরা এই সরকারের ওপর চেপে বসেছে। এই জগদ্দল পাথর থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে একটা কিছু করতে হবে।”
আয়োজক সংগঠন বাংলাদেশ সিভিল রাইটস সোসাইটির সভাপতি জাকির হোসেনের স্বাগত বক্তব্যে আলোচনা সভায় বিএসএমএমইউর সাবেক উপ-উপাচার্য্ অধ্যাপক এম এ মান্নান মিয়া, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের প্রধান অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নুরুল হক নূর, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা মুনির হোসেন কাশেমী, সমন্বিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম পথিক, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সহ-প্রধান তাসলিমা আখতার, বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের সাংঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন, হালকা যানবাহন পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সাউথ-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারহাদ হোসেন, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।