দুর্নীতি প্রতিরোধে আইএমএফের পরামর্শ কার্যকর করতে পারলে উন্নয়নের গতি আরও ৩ শতাংশ বাড়বে। আর সাধারণ মানুষের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা ভালোভাবে মেটানো যাবে-এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, যদি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে বেড়ে যাবে আয় বৈষম্য। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে হতদরিদ্র নিরসনের লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সরকার নিজেও অঙ্গীকার করেছে এ বিষয়ে। এখন আইএমএফও বলছে। কারণ এটি কার্যকর হচ্ছে না।
বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) কান্ট্রি রিপোর্টের ওপর অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বুধবার যুগান্তরের কাছে উল্লিখিত মন্তব্য করেন। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
আইএমএফের কান্ট্রি রিপোর্টে বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সুশাসন নিশ্চিতের বিষয়টি। সংস্থাটি বলেছে, বিনিয়োগ আকর্ষণে তখনই সহায়তা করবে যখন শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী করে দুর্নীতির ঝুঁকি কমিয়ে কাঠামোগত উন্নয়ন করা যাবে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ এবং হালনাগাদ করার মানসম্পন্ন পদ্ধতি প্রণয়ন করার কথাও বলা হয়। তবে দুর্নীতি কমাতে সরকারি খাত ডিজিটালাইজেশনের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আইএমএফের প্রতিবেদন টিআইবির বাস্তবতা প্রমাণ হয়েছে। এখন সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করা। সেটি করতে পারলে দেশের উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
বিশেষ করে এসব পরামর্শ কার্যকর করা হলে উন্নয়নের গতি আরও ৩ শতাংশ বাড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে।
কিন্তু দুর্নীতির কারণে আয়বৈষম্য বাড়ছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে হতদরিদ্র দূরীকরণে যে ভিশন নির্ধারণ করেছে সেখানে পৌঁছানো কঠিন হবে। ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সরকার নিজেও অঙ্গীকার করেছে এ বিষয়ে। এখন আইএমএফও বলছে। কারণ এটি কার্যকর হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের দুর্নীতি নিয়ে আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে এটি নতুন কিছু নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানের পর দুর্নীতিতে অবস্থান বাংলাদেশের। ফলে আইএমএফের প্রতিবেদন ঠিক আছে। কিন্তু বর্তমান সরকার দুর্নীতি বন্ধে আন্তরিক এটি আমি বলতে পারছি না।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করা নতুন কিছু নয়। আর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবে দ্বিমতের সুযোগ নেই। সরকারি খরচের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে অপচয় হচ্ছে। যে কারণে সরকারি বিনিয়োগের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় ৫ বছর মেয়াদের প্রকল্প শেষ হতে ৯ বছর লেগে যাচ্ছে। এতে বাজেট এক টাকা থেকে বেড়ে তিন টাকা দাঁড়াচ্ছে। দুর্নীতির কারণেই মূলত প্রকল্প সময়মতো শেষ করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা গুরুত্বপর্ণূ। বিশেষ করে বাস্তবায়নে যারা জড়িত, তাদেরই নির্ধারণ করতে হবে-ব্যর্থতার দায় কার। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দরজা খুলে যাবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের টাকা আয় ঘিরেও দুর্নীতি হয়। বিশেষ করে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে। করদাতা কর দিলেও ঠিকমতো কোষাগারে জমা হয় না। লিকেজ থাকছে সেখানে। ফলে রাজস্ব আহরণের বড় বাধার একটি হচ্ছে দুর্নীতি। এ জন্য করদাতা ও করগ্রহীতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক এড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারি আয় ও ব্যয়ের মধ্যে দুর্র্নীতির প্রভাব কমাতে পারলে সাধারণ মানুষের কল্যাণ আকাঙ্ক্ষা ভালোভাবে মেটানো সম্ভব।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমানো, বাণিজ্যকেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিল্পকেন্দ্রিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। মামলার জট কমাতে আদালতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সম্পত্তির অধিকার ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা জোরদার করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিমারির অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্ব সংক্রান্ত কিছু ঝুঁকি রয়েছে। এ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যে অংশীদার দেশগুলোতে পুনরুদ্ধারের গতি প্রত্যাশার চেয়ে কম থাকা, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সাইবার আক্রমণের আশঙ্কা। অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে প্রত্যাশার তুলনায় করোনার টিকাদানের হার কম থাকা এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি।
এছাড়া বাংলাদেশের দুর্বল ব্যাংক খাত কোভিডের কারণে আরও দুর্বল হয়েছে। মধ্য মেয়াদে টেকসই ও উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শক্তিশালী ব্যাংক খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ খাতের অবস্থার উন্নতির জন্য কোভিড মোকাবিলায় ঋণগ্রহীতাদের দেওয়া সুবিধা থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসা, নিয়ম-কানুন ও তদারকি জোরদার এবং ঋণদাতার অধিকার সুরক্ষায় আইনি সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
এ ছাড়া বলেছে, আর্থিক খাতে সুশাসন এবং দক্ষতা উন্নয়ন মধ্যমেয়াদের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফ বলেছে, রাজস্ব প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে একটি বহুমুখী রাজস্ব কৌশল হাতে নিতে হবে। বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে রাজস্বনীতি কাঠামোতে সংস্কার আনতে হবে।
সামাজিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু সম্পর্কিত ব্যয় বাড়ানোর আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নের জন্য সরকারের ঋণগ্রহণ সম্পর্কিত ঝুঁকি কম রয়েছে। তবে টেকসই উপায়ে উন্নয়ন এবং সামাজিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব আহরণের হার আরও বাড়াতে হবে।