বিশ্ব কিডনি দিবস আজ

Untitled-13-5c89522aa8cba

মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন পাসের পর ধারণা করা হয়েছিল, কিডনি রোগে আক্রান্তরা সুফল পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। গত বছর এই আইন পাসের পরও দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের হার বাড়েনি। বর্তমানে বছরে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। আইনে নির্দিষ্ট সংখ্যক নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে কিডনি সংগ্রহ করার বিধান রাখা হয়নি। সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দাতা শ্রেণির (ডোনার পুল) আকার ছোট হয়ে আসার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় তারা ক্যাডাভারিক (মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন) প্রক্রিয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। প্রতি বছর মার্চের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এ দিবসটি পালন করা হয়। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য, সর্বত্র’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কিডনি রোগীদের জন্য রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে একটি ডায়ালাইসিস কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে দরিদ্র রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পান। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুরু থেকেই আইনে কিডনিদাতার ধারাটির বিরোধিতা করে আসছেন। তিনি সমকালকে বলেন, আগের আইনে চারজন নিকটাত্মীয়ের কিডনি দানের বিধান থাকলেও সংশোধিত আইনে তা বেড়ে ১২ জনে দাঁড়িয়েছে। এরপরও বিস্তৃত পরিসরে কিডনি সংযোজন করা সম্ভব হবে না।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সংশোধিত আইনে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং রক্তের সম্পর্কের আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা- এই ১২ জন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পরিবারগুলোতে ভাই-বোনের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। অনেক সময় তাদের কিডনিও ম্যাচ হয় না। এ ছাড়া মা-বাবার বয়স বেশি হওয়ার কারণে তারাও কিডনি দিতে পারেন না। এসব কারণে ডোনার পুল ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।

একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বছরে প্রায় ৯ হাজার মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি ১০টি হাসপাতালে বছরে মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে এক শতাংশের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয় না। অন্যরা চিকিৎসাবঞ্চিত থাকছেন। এ অবস্থায় পাস হওয়া ওই আইনের কারণে রোগীরা আরও বঞ্চিত হবেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মডেল অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ভারতে নিকটাত্মীয়ের কাছে কিডনি পাওয়া না গেলে দানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বোর্ড আছে। সেই বোর্ড যাচাই-বাছাই করে কিডনি সংযোজনের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশেও এ আইনটি অনুসরণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যে কোনো সুস্থ ব্যক্তি নিজের ক্ষতি না করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন- এ ধারাটি যুক্ত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কিডনি প্রতিস্থাপন সুবিধা দরিদ্র মানুষের দোরগোরায় পৌঁছে দিতে কিডনিদাতাকে সরকারিভাবে নূ্যনতম ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে কিডনি নিয়ে বাণিজ্য বন্ধের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষ সেবা পাবেন।

কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ সমকালকে বলেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে মোট কিডনি প্রতিস্থাপনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। কিডনি প্রতিস্থাপনের হার বাড়াতে হলে বিকল্প ভাবতে হবে। তিনি বলেন, অনেক দেশে ক্যাডাভারিক প্রক্রিয়ায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ প্রতিস্থাপন করা হয়। আমাদের দেশে জীবিত নিকটাত্মীয়ের দেহ থেকে কিডনি বিযুক্ত করে শতভাগ কিডনি সংযোজন করা হয়। এতে করে ডোনার সংকটে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী মারা যান।

ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমাদের দেশে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে কোনো অঙ্গই নেওয়া হয় না। যকৃত, হূৎপিণ্ড, চোখ, ফুসফুস, প্যানক্রিয়াস ও ইন্টেস্টাইন অর্গান ফেইলিওর হওয়া আট থেকে নয়জন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা বা সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে একজন মৃত ব্যক্তির এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তাই আমাদের ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্টেশনের দিকে যেতেই হবে।

কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি বিকল হয়ে মারা যাচ্ছেন। শতকরা ৫ ভাগ মানুষেরও দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। ৭৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পরও বুঝতে পারেন না যে, তিনি ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত।

কিডনি ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- ১৬-১৮ শতাংশ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি প্রদাহের কারণে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কিডনি বিকল হয়। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে কিডনি রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে। গবেষণায় আরও বলা হয়, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ শুধু এই অঙ্গটিই বিকল করে না, এর সঙ্গে হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ ও রক্তানালির রোগের মৃত্যুঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।

ন্যাশনাল কিডনি ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজির (নিকডু) সাবেক পরিচালক এবং বর্তমানে ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রফিকুল আবেদীন জানান, পাঁচ বছর আগে প্রতিদিন গড়ে যেখানে ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসতেন, সেখানে বর্তমানে ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগী আসেন। এতে প্রমাণ হয়, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

নিকডুর পরিচালক অধ্যাপক ডা. নুরুল হুদা লেলিন বলেন, দেশে মাত্র ৯৬টি ডায়ালাইসিস সেন্টার আছে। ব্যাপক সংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় এ সংখ্যা খুবই কম। এসব সেন্টারে মাত্র ১৮ হাজার রোগী সপ্তাহে দুবার করে ডায়ালাইসিস সুবিধা পান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিবার ডায়ালাইসিস করার সামর্থ্য নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের নেই। তিনি বলেন, মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস সুবিধা পান। অন্যরা অর্থাভাবে এ সুবিধা একেবারেই পান না।

কিডনি রোগ ও করণীয় :কিডনি রোগ প্রতিরোধে আটটি পরামর্শ মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নিকডুর নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বাবরুল আলম বলেন, কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করা এবং নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করলে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

চিকিৎসাও সংকটের মুখে :দুই কোটিরও বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেও দেশের বড় বড় হাসপাতালে এ রোগের জন্য পৃথক কোনো ইউনিট নেই। সারাদেশে মাত্র ৮০-৯০ জন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। পুরনো আটটি মেডিকেল কলেজেও সবগুলোতে ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। নিকডু ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, মুগদা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা. সিলেট, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা আবু নাসের, সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু আছে। অন্য সরকারি হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিৎসা নেই।

তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী প্রত্যেক জেলা সদর হাসপাতালে একটি পৃথক কিডনি রোগের চিকিৎসা ইউনিট স্থাপন করা হবে। এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কমমূল্যে ডায়ালাইসিসের সুবিধা পাবেন।

কর্মসূচি :দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। বিএসএমএমইউতে আজ সকালে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।

Pin It