বঙ্গবন্ধু একটি দর্শনের নাম

mujib-1971-03-1024x660

গোপালগঞ্জের অজপাড়া গাঁ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এক শিশু। নাম তার খোকা। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিশু থেকে দুরন্ত কৈশর। মধুমতি নদীতে সাঁতার কেটে টগবগে যুবকে পরিণত হয় সেই শিশুটি। কালক্রমে এই খোকা হয়ে ওঠেন বাংলার মহানায়ক।

তিনি আর কেউ নন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনিই বিশ্ববন্ধু। তিনি জাতির পিতা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া শিশুটি খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে যে ইতিহাস সেটার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে তার অদম্য নেতৃত্ব আর ত্যাগ।

স্বনামধন্য লেখক আহমদ ছফা শেখ মুজিবুর রহমান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে’।

তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। পরিবারের সবাই ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। কেউ কি ভেবেছিলেন শেখ পরিবারের আদরের ছোট্ট খোকা একদিন বিশ্বনন্দিত নেতা হবেন কিংবা স্বাধীনতায় নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা?

গভীর দেশপ্রেম, সীমাহীন আত্মত্যাগ ও অতুলনীয় নেতৃত্বে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে নেতৃত্বের জন্য জনগণ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম, নির্যাতন-কারাবরণের কারণে ইতিহাসে তাকে জাতির পিতার অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়।

মার্চ ঐতিহাসিক মাস। এ মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এই মাসেই তিনি জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ মাসেই তিনি নিজেদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকালই অসম্ভব সৎ এবং নিষ্ঠাবান ছিলেন। ক্যারিশমাটিক এই নেতা তার আবেগময় জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে সহজেই জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারতেন, সেজন্যই নেতা হিসেবে তিনি জনমানসে হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন, সহজ সরল ছিলেন বলেই কে শত্রু আর কে মিত্র সেটি বঙ্গবন্ধু চিনতে পারেননি, সরল বিশ্বাসে পুরো জাতিকেই তার সন্তান বলে মনে করেছেন এবং সন্তান যে একদিন পিতাকে হত্যা করবে – এমন ভাবনা বা আশংকা তার মধ্যে কোনোদিনও আসেনি। মুজিব-এর হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পেরে তাজউদ্দিন স্বগতোক্তি করেছিলেন,

‘বঙ্গবন্ধু জানতে-ও পারলেন না কে তার শত্রু আর কে তার বন্ধু ছিল’!

হেনরী কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলাপকালে মি. এথারটন বলেছেন,

‘He brushed it off, scoffed at it, said nobody would do a thing like that to him.’

বাংলায় যার অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘তিনি (মুজিব) তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বলেন, তাঁর সঙ্গে এমন কিছু কেউ করতেই পারে না।’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে কতটা সোজা সরল মানুষ ছিলেন, সেটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু মিন্টো রোডে প্রেসিডেন্ট হাউজে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস করতেন, তারপর চলে আসতেন শেরেবাংলা নগরের সচিবালয়ে যেখানে তিনি রাত ৯/১০টা পর্যন্ত অফিস করতেন। ওখানেই তিনি দুপুরে কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন, সময় সুযোগ পেলে বিকেলে লেকে মাছদের খাবার দিতেন, লনে একটু হাঁটাহাটি করতেন। বঙ্গভবন বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসভবন হলেও তিনি রাতে ওখানে থাকতেন না, থাকতেন ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের নিজ বাড়িতে। একজন রাষ্ট্রনায়ক সরকারি সুযোগসুবিধা নিচ্ছেন না এবং নিজের নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি ফোর্স রাখছেন না – এখান থেকেই সুস্পষ্ট হয়, বঙ্গবন্ধু কোনোদিনও দুর্নীতিবাজ ছিলেন না। একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক মুজিব সম্পর্কে বলেন,

“অন্যান্য মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির মত মুজিবও তার বাড়ি ভালবাসতেন। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখনও তাঁর বসবাসের ধরন পরিবর্তিত হয়নি। তাঁর বাড়িতে কোন গালিচা বা নতুন আসবাবপত্র ছিলোনা। তিনি মাছ, মুড়ি, দই ও গুড় পছন্দ করতেন। তিনি লুঙ্গী ও গেঞ্জি পরে বাসায় বিশ্রাম নিতেন। তিনি একজন মধ্যবিত্ত বাঙালিই থেকে যান!”

সদ্য ভূমিষ্ঠ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতার কত কথাই না অজানা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে। একটি ঘটনার কথা বলি। হ্যা আজ তার দর্শন আমাদের কাছে গল্পের মতই শোনায়। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন চিফ সিকিউরিটি অফিসার এবং মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি। আমরা তাকে মোটামুটি সবাই চিনি। তার লেখা বইতে জাতির জনক সম্পর্কে অনেক ধারণা নেওয়া যায়। জনকের দর্শনে আসি।

একদিন গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর মাঝ পথে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামিয়ে বললেন, বাবুবাজার যাও। চাউলের দাম কতো তা যাচাই করতে হবে। এদিকে তাকে পাহারারত গাড়ি অনেক দূরে চলে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কথায় গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দৌড়ে গিয়ে ব্যবস্থা নিতে হলো। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে একাই বসে ছিলেন একেবারে নিরাপত্তাহীন।

আবার কখনো বলতেন, মিরপুর বস্তিতে যাব। বস্তির মানুষ কিভাবে আছে তা দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে দেশের রাষ্ট্রপতি বা দেশের প্রধান তার নির্দেশতো অমান্য করার কোন অবস্থা আমার বা অন্য কারো ছিলো না।

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের কারণে প্রায়ই সময়ই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। তিনি বলেন,

একদিন আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম স্যার, আমাকে দুইটি ওয়ারলেস সেট কিনে দিন। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওয়ারলেস সেট দিয়ে তুই কী করবি। তখন বলেছিলাম, স্যার কোথাও যাওয়ার সময় মাঝপথে মত পাল্টাচ্ছেন তখন আপনাকে অনিরাপদ রেখে ছুটতে হয়। ওয়ারলেস সেট থাকলে আপনাকে একা ফেলে দৌড়ে যেতে হবে না। বঙ্গবন্ধু তখনও আমার কথায় সাড়া দেননি।

বঙ্গবন্ধুর চিফ সিকিউরিটি অফিসার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরও বলেন,

সে সময় ই এ চৌধুরী নামের একজন এসপি ছিলেন। তাকেও ওয়ারলেস কেনার বিষয়ে জানিয়েছিলেন। একদিন এসপি ই এ চৌধুরী আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ারলেস সেট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বললেন। তখন এর দাম কতো জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, ২২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আরও বেশি দামের রয়েছে। এ সময় ওয়ারলেস সেটের দাম শুনে ধমক দিলেন এবং বললেন আমার দেশের মানুষ না খেয়ে মরে যাচ্ছে, যুদ্ধবিধস্ত দেশ, পাকিস্তান দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলে রেখে গেছে আর তুই আমার নিরাপত্তার জন্য ওয়ারলেস কিনতে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করবি। তখন উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেন, জন এফ কেনেডিকে মেরে ফেলেছে। তার নিরাপত্তার জন্য কতো ব্যবস্থা ছিল। কই এতো নিরাপত্তায়ও তো কেনেডিকে বাঁচানো যায়নি। আল্লাহ যখন মৃত্যু লিখে রেখেছে তখনই আমার মৃত্যু হবে। এভাবেই ওয়ারলেসে সেট কেনার বিষয়টি বাতিল করে দেন বঙ্গবন্ধু।

ইতিহাস আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায় কিন্তু তা আমরা গ্রহণ করতে চাই না। জাতির পিতার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র যদি আমাদের নেতারা নিতে পারতেন তাহলে এই দেশ ‘সোনার বাংলা’ হতে পঞ্চাশ বছর লাগত না।

Pin It