গত কয়েক বছর ধরে বজ্রাঘাতে প্রাণহানি বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এতে জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে প্রবল আতঙ্ক। গত মার্চ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনেই সারাদেশে ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের প্রায় সবাই মাছ ধরছিলেন অথবা জমিতে কৃষিকাজ করছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত বাড়ার পেছনে উষ্ণতা বৃদ্ধির দায় সর্বাধিক। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। এ কারণে এ সময়টাতেই বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে দশমিক ৭৪ শতাংশ তাপমাত্রা বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্কফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। উন্নত দেশগুলোতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই মাঠে বা নদীতে কাজ করেন। গত পাঁচ মাসে বজ্রপাতে প্রায় আড়াই শ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে মে মাসের প্রথম ১০ দিনে মারা গেছেন ১১২ জন। পৃথিবীতে বজ পাতে যতসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একসময় দেশের বেশির ভাগ গ্রাম এলাকায় বড়ো বড়ো গাছ থাকত। তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের বড়ো গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। ফলে মানুষের আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা কম ছিল।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। হঠাত্ বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, যত্রতত্র মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানো, তাপমাত্রা বৃদ্ধিও বজ্রপাতের উল্লেখযোগ্য কারণ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূঁইয়া বলেন, প্রাকৃতিক কারণেই বজ্রপাত হয়। বাংলাদেশে বজ্রপাত প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে আছে। এ কারণে জলীয়বাষ্প যখন এর সংস্পর্শে আসছে, বজ্রপাতও আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে। বজ্রমেঘ বা সিভি ক্লাউডের কারণে বজ্রপাত হয়। যখন জলীয়বাষ্পসহ গরম বাতাস ওপরের দিকে ওঠে, জড়তার ভ্রামকের কারণে এ মেঘ অনেক ওপরে উঠে সুপারকুল ওয়াটার ড্রপলেস কণায় পরিণত হয়।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে তা নিচে নামে। গরম বাতাসের সংস্পর্শে আবার জলীয়বাষ্পে পরিণত হয়ে ওপরে উঠে যায়। এভাবে কয়েক দফায় ওঠানামা করে কণাগুলো। এতে কণাগুলো বৈদ্যুতিক চার্জসম্পন্ন আয়ন কণায় পরিণত হয়ে বিপুল শক্তির বিদ্যুত্ উত্পন্ন করে। পরিভ্রমণকারী কণাগুলো নিষ্ক্রিয় (নিউট্রাল) হওয়ার চেষ্টা করে। ভূপৃষ্ঠের বিপুল পরিমাণ আয়ন ধারণের ক্ষমতা রয়েছে। তাই ভূপৃষ্ঠ কণাগুলোকে আকর্ষণ করে। এতে কণাগুলো আকাশ থেকে মাটির দিকে ধাবিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বজ্রপাত বলে। তখন এর সন্নিকটে কেউ থাকলে তার মৃত্যু হয় অথবা জখম হয়। তিনি জানান, বজ্র সরাসরি মাটিতে পড়ে না, বিদ্যুত্ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর পরিবহন পদ্ধতির মাধ্যমে বজ্রের বিদ্যুত্ মাটিতে চলে গিয়ে নিউট্রাল হয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এইচ এম আসাদুল হক বলেন, মানুষের শরীর বিদ্যুত্ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্র পড়ার মতো কোনো বিদ্যুত্ পরিবাহী পদার্থ না থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে, যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুত্ পরিবাহীর চেয়ে বেশি, তাহলে তা মানুষের ওপর পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাওহিদা রশিদের মতে, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি। কারণ ওখানে হাওরের জন্য জলীয়বাষ্প বেশি হয়। বৃষ্টিসহ বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর।
সুনামগঞ্জ : হাওরে মাছ ধরার সময় বজ্রপাতে তকবির মিয়া (১২) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলার দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নে মিলন বাজারে এ ঘটনা ঘটে। দিরাই থানার অফিসার ইনচার্জ কে এম নজরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বান্দরবান : বজ্রপাতে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বিকালে সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়নের মুসলিম পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : উপজেলায় বজ পাতে জুবেল উদ্দিন (১২) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে সে মারা যায়। কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুল আলম ভুঁইয়া নিহতের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) : উপজেলায় বুধবার রাতের বজ পাতে মোহাম্মদ জামাল মিয়া (৫০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার আনেহলা ইউনিয়নের বগাজান গ্রামের রুস্তম আলীর ছেলে।
হবিগঞ্জ : বাহুবল উপজেলায় দুই শিশু-কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে পৃথক স্থানে এই দুটি ঘটনা ঘটে। বাহুবল থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান জানান, সকালে ওরকাইদ তার বড়ো জুনাইদের সঙ্গে বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি বিলে মাছ ধরতে যায়। হঠাত্ বজ পাত হলে ঘটনাস্থলে ওরকাইদ মারা যায়।
জয়পুরহাট : বজ্রপাতে সুকমল চন্দ্র সরকার (৫০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে সদরের পারুলিয়া গনকবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
চাটমোহর (পাবনা) : বৃহস্পতিবার বিকালে বজ পাতে শরিফুল ইসলাম (৩০) নামে এক কৃষি শ্রমিক মারা গেছেন।
ফুলবাড়ীয়া (ময়মনসিংহ) : উপজেলায় বজ পাতে তিন জন নিহত হয়েছে। এদিন দুপুরে বৃষ্টির সঙ্গে বজ পাতে তারা মারা যান। নিহতরা হলেন, জঙ্গলবাড়ী গ্রামের আ. মোতালেব (৫০), আছিম পাটুলি খামখেয়ালি এলাকার রবিন (১৩), বিদ্যানন্দ গ্রামের ইমরান (১৮)। ফুলবাড়ীয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বিধান চন্দ্র দেবনাথ বজ পাতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কাহালু (বগুড়া) : উপজেলায় মোখলেছার রহমান (৫৮) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।