মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার ঘটনায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের পূর্ণ তদন্তের শুরুর পথে এগিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্ত শুরুর জন্য কৌঁসুলি ফাতোও বেনসুদার আবেদন শুনানির জন্য বুধবার তিন বিচারকের এক বেঞ্চ ঠিক করে দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত এই আদালতের প্রধান।
আবেদন মঞ্জুর হলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংতার অভিযোগের তদন্তে এটাই হবে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্যোগ।
এক বিবৃতিতে বেনসুদা বলেন, ঘটনার একটি পক্ষ বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য হওয়ার যুক্তি তুলে ধরে তিনি এই অভিযোগ তদন্তের জন্য বিচারকদের কাছে অনুমতি চাইবেন।
তিনি আরও বলেন, মিয়ারনমারের ‘রাখাইন অঞ্চলে সহিংসতার দুটি প্রবাহের প্রেক্ষিতে’ সংঘটিত অপরাধকে কেন্দ্র করে তার তদন্ত হবে।
গত সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত আসার পর প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়।
মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য না হওয়ায় সেখানে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার সরাসরি কোনো এখতিয়ার এ আদালতের নেই।
কিন্তু রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, এভাবে তাদের বিতাড়নের বিষয়টি যেহেতু আন্তঃসীমান্ত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এবং বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য, সেহেতু আইসিসি বিষয়টি তদন্ত ও বিচার করতে পারে কি না- সেই প্রশ্ন রেখে গত বছর এপ্রিলে একটি আবেদন করেন ওই আদালতের প্রসিকিউটর ফাতোও বেনসুদা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য এবং বিভিন্ন অধিকার সংগঠনের যুক্তি শুনে আইসিসির তিন বিচারকের প্রি ট্রায়াল প্যানেল গত ৬ সেপ্টেম্বর সিদ্ধান্ত দেয়- এ বিষয়টি বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে।
আইসিসির ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়,“ব্যক্তিগত দুর্দশার বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে সেখানে অভিযোগ সাজানো হয়েছে, যার সঙ্গে আইনি যুক্তির কোনো যোগাযোগ নেই, বরং আবেগের জায়গা থেকে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।”
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল।
গত এক বছরে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কথায় উঠে এসেছে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়।
তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের ওই দাবি নাকচ করে দিয়ে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।