সত্তরের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমিতে বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা আন্দোলন ছিল না, বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক তথা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত ছিল।’ ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে সামাজিক রাজনীতির ইতিবাচক বাঁকে এবং সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের ধারাবাহিকতায় বলিষ্ঠ নিশ্চিত পদচারণা প্রত্যক্ষ করেছে। চৌষট্টি বছর আগে মহান একুশের চেতনা, মায়ের ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, সাময়িক ব্যর্থতার গ্লানি অগ্রাহ্য করে সংগ্রামকে ধাপে ধাপে আরও বেগবান করা এবং সাফল্যের বরমাল্য বাঙালি জাতিকে নতুন উপলব্ধি ও প্রত্যয় এনে দিয়েছিল। এর পর চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়ের পর ছাপ্পান্নর সংবিধানে আংশিক হলেও সফলতা অর্থাৎ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে পারার ঘটনাও তাৎপর্যবহ। আটান্নর সামরিক আইনবিরোধী দুর্বার গণআন্দোলন, বাষট্টিতে বাঙালির শিক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিনাশকারী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তীব্র রক্তক্ষয়ী সফল সংগ্রাম, ছেষট্টিতে বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফার আত্মপ্রকাশ, ১১ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং গৌরবোজ্জ্বল একাত্তর এবং মহান স্বাধীনতা। এর প্রতিটি ধাপে একুশের চেতনা বাতিঘর হয়ে পথ দেখিয়েছে বাঙালিকে।
ড. হেনরী কিসিঞ্জারসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ও সমাজ বিশ্লেষকরা দেশটির জন্মের পরই বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তিজনক নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কেউ কেউ বলেছিলেন, কোনোমতে ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী টিকে থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না।
হয়ে যাবে তলাবিহীন ঝুড়ি। ১৯৭৬ সনে ড. ফাল্যান্ড ও ড. পারকিনসন তাদের ‘বাংলাদেশ এ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইতে উল্লেখ করেন, ‘এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারে তাহলে দুনিয়ার যে কোনো দেশই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারবে।’ ২০১২ সালের ৩ নভেম্বর দ্য ইকোনমিস্ট ‘আউট অব দ্য বাসকেট’ শিরোনামের এক বিশ্লেষণে বলে, ‘কী করা যায়, সেটি দেখিয়ে দেওয়ার মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কি করে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া যায়, সেটি দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’
স্থিতিপত্র আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি
২০১৫ সালের সমষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চহারে, ইহার সামাজিক রূপান্তরে এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে বিশ্ববাসী বিস্মিত না হয়ে অভ্যস্ত হয়ে ইহাকে বাংলাদেশ বৈশিষ্ট (Bangladesh Phenomenon) হিসাবে মেনে নিয়েছে। সিএনএন মানিগ্রাম বলছে ২০১৫ সালে পাঁচটি দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৯ সালে দেশটি গণচীন ও ভারতবর্ষের সঙ্গে দ্রুততম প্রবৃদ্ধির তিনটি দেশের মধ্যে থাকবে। ব্লুমবার্গের মতে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তিনটি দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশে উন্নীত হয়েছে ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের পিইইউ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে আগামী পঁচিশ বছরে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির মাপে পৃথিবীর তেইশতম বৃহৎ অর্থনীতি হবে (২০১৫ সালে চৌত্রিশতম) বাংলাদেশ। অর্থনীতির আকারে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে। মাস্টার কার্ডের জরিপ অনুসারে ২০১৫ সালের শুরুতে এশিয়া প্যাসিফিকের ১৬টি দেশের মধ্যে কনজুমার কনফিডেন্স ইনডেক্সের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬.৯ শতাংশ যা মোট ৮৩.৩ পয়েন্টে পৌঁছে যায়। দেশের শতকরা ৭২ ভাগ লোক নিজের আর্থসামাজিক অবস্থানে সন্তুষ্ট এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি সম্পর্কে আশাবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দলীয় থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন হিসাব করছে যে ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল ও কৃতসংকল্প পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ ২১টি দেশের মধ্যে মোবাইল সক্ষমতায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ২০১৬ সালে ৪ জি শুরু হয়ে গেলে অবস্থানটি আরও মজবুত হয়েছে।
শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা বিষয়ে জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা UNIDO কর্তৃক হিসাবিত Competitive Industrial Performance Index (CIP) অনুসারে ২০০টি দেশের মধ্যে ২০১০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮০; ২০১৩ সালে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭এ উঠে আসে। এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনার দৃষ্টিনন্দন সক্ষমতার ইতিবাচক প্রবাহ আর্থসামাজিক অগ্রগতিকে দ্রুততর করেছে। বস্টন কনসালন্টিং গ্রুপ বিসিজি ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছে যে বাংলাদেশে এখন এক কোটি বিশ লাখ লোক বার্ষিক পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার উপার্জনকারী ভোক্তাপণ্যের শক্তিধর চাহিদার উৎস যা ফি বছর শতকরা দশ ভাগ হারে বাড়বে। অর্থাৎ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ খুবই চমৎকার ক্ষেত্র। অন্য একটি গবেষণা মতে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ও হার কমছে (বর্তমানে শতকরা ২১ ভাগ) অর্থাৎ দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে ভোগ্যপণ্য চাহিদা বৃদ্ধিকারী মধ্যবিত্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ১৯৭২ সালে ৭.৫ কোটি জনসংখ্যার ৫.৫ কেটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিলেন আর ২০০৯ সনে ৪০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিলেন আর ২০১৯ সালে ২০.৫ শতাংশ। দেশে কোটিপতির সংখ্যা এখন প্রায় ৫৪,০০০ (মতান্তরে সোয়া লাখ) এবং প্রতিবছর আরও পাঁচ হাজার লোক নতুন করে কোটিপতি হচ্ছেন। ড. বিনায়ক সেন ও বিআইডিএস-এর একটি গবেষণা সমীক্ষায় দরিদ্রদের মধ্যবিত্তদের কাতারে উঠে আসার কথা বলা আছে যদিও এতে ব্যক্তি আয় ও আঞ্চলিক আয়ে বিপুল বৈষম্যের চিত্রও ফুটে উঠেছে।
স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশে গ্র্যাজুয়েশন করতে জাতিসংঘের তিনটির মধ্যে তিনটি সূচকে উত্তীর্ণ হতে হবে, যথা, (ক) মাথাপিছু আয় বিশ্বব্যাংকের অ্যাটলাস পদ্ধতিতে ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হবে (খ) মানবসম্পদ সূচক হিউম্যান এসেট ইন্ডেক্স ৬৬.০ হতে হবে (বর্তমানে ৬৩.৮) এবং (গ) অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে (ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইন্ডেক্স) হতে হবে ৩৩.৪-এর কম। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৮২৭ ডলার, মানবসম্পদ সূচক ৭৫.৪ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ২৫ হওয়ার সুবাদে অসাধারণভাবে তিনটি সূচকেই একযোগে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৮ সালে প্রাথমিকভাবে এবং ২০২১ সালে চূড়ান্তভাবে ইউএন কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (UNCDP) বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ভূষিত করেছে। ২০২৫ সাল ও তার পরবর্তী সময়ে জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
সামাজিক অগ্রগতি
সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই সূচকের শীর্ষ অবস্থানে। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি শতকরা ১.১৩ ভাগ, নারীর প্রজনন প্রবণতা নেমে এসেছে ২ এ। শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ৩১, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হার শতকরা ২১ এবং হ্রাসমান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত জনমিতির অনুরূপ, উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরতদের সংখ্যা প্রায় ৩১ লাখ অর্থাৎ জসংখ্যার প্রায় ০২ শতাংশ এবং সমবয়সীদের এক পঞ্চমাংশ। চুয়াল্লিশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী সংখ্যা বেড়েছে ১০০ গুণ। জন্মকালীন গড় আয়ু এখন প্রায় ৭২ বছর। তবে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েও এখন প্রতি লাখে জন্মে ৯১; এ দুর্বলতাকে কাটাতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগ। নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, নারী নেতৃত্বাধীন পরিবারের সাফল্য এবং চাকরির ক্ষেত্রে নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতি উৎসাহব্যঞ্জক। তবে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বেই নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন ঘটায়। রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কর্মকর্তা নির্বাচনে এবং সব ধরনের নির্বাচনে নারীর মনোনয়ন এখনো নগণ্য অনুপাতে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্স ২০১৫ প্রকাশ করে দেখিয়েছে যে ২০১৪ সালের সূচকের তুলনায় বাংলাদেশ চার ধাপ এগিয়ে ৬৮তম থেকে ৬৪তম স্থানে উঠে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য উল্লেখযোগ্য দেশ ভারতের অবস্থান ১০৮। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের ২০১৫ সালের সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, ২০০৩ সালে বাংলাদেশে মোট নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১২,২৯,৪১৩ অর্থাৎ মোট কর্মজীবীর শতকরা ১০.৯১ শতাংশ। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০,৫১,৭১৮ যা মোট কর্মজীবীর ১৬.২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে শিক্ষার হার ১৯৭২ সালে ছিল শতকরা ২৪ ভাগ। ২০১৯ সালে এ হার শতকরা ৬৩ ভাগে উন্নীত হয়।
লন্ডনভিত্তিক চাইল্ড রাইটস ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কের (সিআরআইএন) সূচক অনুসারে শিশুদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ২০০ দেশের মধ্যে ১ম, ২য়, ৩য় ও ১০ম স্থানে রয়েছে বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন ও কেনিয়া। আর ৪৩তম, ৬৩তম, ৭৮তম, ৮৫তম ও ১৮৯তম স্থানে অবস্থান করছে ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ।
অর্থনৈতিক চিত্র
বাংলাদেশের কৃষি ও মৎস্য খাতের ধারাবহিকতা চমৎকারিত্বের দাবিদার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ছিল ১ (এক) কোটি টন; ২০১৯ সালে তা ৪.১৫৫ (পৌনে চার) কোটি টন। ২০১৩ সালের ওই হিসাবে কোটি টনের অঙ্কে খাদ্যশস্য উৎপাদন গণচীন (৫৫.১১), যুক্তরাষ্ট্র (৪৩.৭), ভারতবর্ষ (২৯.৩৯), ব্রাজিল (১০.১), রাশিয়া (৯.০৩), ইন্দোনেশীয়া (৮.৯৭), ফ্রান্স (৬.৭৫), কানাডা (৬.৬৩), ইউক্রেইন (৬.৩১) এবং বাংলাদেশ (৫.৫)। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী দেশ। ভিয়েতনামে বাজার পাওয়া যেতে পারে। আলু থেকে উন্নতমানের চিপস আর ফ্রাই বানাতে না পারার কোনো কারণই নেই। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে ৪র্থ; বার্ষিক চাহিদা ৪১ লাখ টন, উৎপাদন প্রায় ৩৮ লাখ টন তন্মধ্যে ইলিশ ৩৮০০০ টন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হিসাবে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ মোট ৩ লাখ টন থেকে ২২ লাখ টনে উন্নীত করেছে যা পৃথিবীতে ৩য় বৃহত্তম।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় সব হিসাব-কিতাবকে ছাড়িয়ে ২০০৮-০৯ সালে ১৫১০ কোটি ডলার এখন ৩৬৬৭ কোটি ডলার। ১৯৭২ সালের মোট জাতীয় আয় ছিল ৯০০ কোটি ডলার; এখন তা ৩৩৪০০ কোটি ডলার। এদিকে য্ক্তুরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য ক্রেতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি পরিচালিত জরিপে আগামী পাঁচ বছরে শীর্ষ তিনটি সরবরাহকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শতকরা ৪৮ ভাগ তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার আমদানিকারক দেশের পছন্দ বলে গণ্য হয়। উৎপাদনে এবং রপ্তানিতে বহুমাত্রিকতা আনা এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাজনীতিতে ইতিবাচক সুবাতাস : অর্থনীতির ওপর প্রভাব
২০১৫ সালের সূচনাটি মোটেও সুখকর হয়নি। ২০০৮ সালে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বাধ্যবাধকতায় সাধারণ নির্বাচন করতেই হতো। প্রচণ্ড বেআইনি প্রতিরোধ ও হানাহানির মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে সে নির্বাচন যথা মেয়াদে অনুষ্ঠিত হয়। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ৬ জানুয়ারি তারিখে ‘আন্দোলন’ শুরু করে। অবরোধ ও হরতাল হয় এর নিত্যসাথী। কিন্তু অধিকাংশ নেতা থাকেন পর্দান্তরালে। সে সুযোগে এবং হিংসাত্মক আন্দোলনের ছত্রছায়ায় একাত্তর সালের পরাজিত শত্রুরা জঙ্গি, সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও খুনিরা, গ্রেনেড, অগ্নি, হত্যা, গুম, ধ্বংস, ককটেল অস্ত্র ব্যবহার করে একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিএনপি চেয়ারম্যান ৫৯ সহকর্মীসহ ৯৩ দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন নিজেকে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে, নিহত হন শতাধিক, ধ্বংস হয় মূল্যবান ধনসম্পত্তি, ধীরগতি হয়ে পড়ে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকা, হুমকির মুখে পড়ে দেশের ভাবমূর্তি। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোক জানাতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি অফিসে ‘অবরুদ্ধ’ মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎই পাননি; তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় দরজা থেকেই। ঘটে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা কর্তৃক বহু চেষ্টার পর টেলিফোনে সংলাপ আমন্ত্রণে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পুনরাবৃত্তি। এদিকে সহিংসতা বন্ধ না করার ঘোষণা না দিয়েই স্বার্থান্বেষী মহল সিভিল সোসাইটি নাগরিক সমাজ সংলাপের ডাক দিতে থাকে, এক/এগারোর প্রেতাত্মারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল অকেজো রাষ্ট্রে পরিণত করার সব চেষ্টাই করেছে।
তবে পরিস্থিতির স্বস্তিদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আদালতের শরণাপন্ন হয়ে জামিন নিয়ে বাসভবনে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে।তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সব গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে আসে প্রচণ্ড গতি। বিগত কয়েকটি সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল থেকে বিশেষজ্ঞদের হিসাব, জাতীয়ভাবে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ শতকরা ৩৮-৩৯ আর বিএনপি ৩৪-৩৫ ভাগ জনসমর্থনের অধিকারী। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট লাভ করে। এক/এগারোর দুরভিসন্ধিমূলক যড়যন্ত্রের সমুচতি জবাব দেন জনগণ। ২০১৪ ও ২০১৫ এর নাশকতামূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি সম্পৃক্ততার সন্দেহের কারণে সাময়িকভাবে দলটির ভোটের অংশ কমে থাকতে পারে। তবে সম্প্রতিকালে বিএনপি মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারায় গণতন্ত্রীমনা দেশবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি দুটি বড় রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থানে শঙ্কার সৃষ্টি হলেও উভয় দলই পিছু হটে; স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন দেশবাসী। তবে জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপমানজনক বক্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শহিদানদের প্রতি অবজ্ঞা অপমান থেকে দলটিকে দূরে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব উপলব্ধি
জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা আর্থ’ এবং ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন’ পুরস্কারে ভূষিত করে। তা ছাড়া তাকে খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যে এফএও পুরস্কার প্রদান করা হয়। ওয়াশিংটনের দ্যা ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন চিন্তাবিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৩তম স্থান দিয়ে বিরল সম্মানে দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার আপসহীন ও অকুতোভয় সংগ্রামের কারণে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও ক্ষুধা দারিদ্র নিরসনে তার উদ্ভাবনী নেতৃত্বের কারণেই শেখ হাসিনা এসব সম্মান অর্জন করেন। বিশ্বব্যাংকের বোকামীপ্রসূত ঋণ প্রত্যাহারের অন্যায্য নোটিশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অসমসাহসী নেতৃত্বে শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয় ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে। প্রায় ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের এ পদ্মা সেতু এখন সমাপ্তির পথে। প্রমত্ত ও উত্তাল পদ্মা শেষ পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারা যাবে। ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু পুরোপুরিভাবে চালু হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে শতকরা ০১ ভাগ যোগ হবে; দারিদ্র্য কমবে বছরে ০.৮৮ শতাংশ। অগ্রগতির জোয়ার উঠবে দক্ষিণ বাংলার জনমানুষের ভাগ্যে। অনুরূপভাবে ঢাকার মেট্রোরেল, কর্ণফুলী চ্যানেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ অবকাঠামো ক্ষেত্রে দৃষ্টিনন্দন সাফল্য বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবমূর্তিকে বিশ্বনন্দিত করছে।
আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও জনপ্রশাসন
২০১৫ সাল থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরপত্তা পরিস্থিতি বিশ্ব পরিমণ্ডলে নন্দিত হয়েছে। দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অব পিস ২৩টি বিবেচনা ক্ষেত্রে ১৬২টি দেশে যে জরিপ সম্পন্ন করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম (শ্রীলংকা ১১৪, ভারতবর্ষ ১৪৩, পাকিস্তান ১৫৪)। পক্ষান্তরে শতাধিক বৎসরের ঐতিহ্যবাহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের GALLUP SURVEY ১৪১টি দেশে জরিপ চালিয়ে যে ফলাফল পেয়েছে তাতে দেখা যায় যে সিঙ্গাপুর (৮৯ পয়েন্টস), উজবেকিস্তান (৮৮), হংকং (৮৭), ইন্দোনেশিয়া (৮৭), শ্রীলংকার (৭৯) পরেই ৭৮ পয়েন্ট নিয়ে পৃথিবীর ৬ষ্ঠ নিরাপদতম দেশ বাংলাদেশ। শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার সব প্রচেষ্টাই যে ব্যর্থ হয়েছে এসব মূল্যায়ন তারই সাক্ষ্য বহন করে।
যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের ল অব ল্যান্ড অনুসারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সম্পূর্ণ সুযোগ দিয়ে প্রকাশ্যে বিচার কাজ চলছে। বেশ কয়েকজন পালের গোদার মৃত্যু দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালে। এতে জনমনে স্বস্তি আসে। আইন মান্যকারী দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তবে একটা পর্যায়ে বর্তমানের চলমান ২০-২২টি মামলা সম্পন্ন করার পর নতুন কোনো মামলা শুরু না করাই ভালো হবে বলে মনে হয়। ঢাকার দুই মেয়রের দৃঢ়হস্ত জবরদখল উচ্ছেদের সফলতার ধারাবাহিকতায় আদালতের কয়েকটি রায়ের দ্রুতগতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। দ্রুততম গতিতে সিলেট ও খুলনায় শিশু হত্যার বিচার হয়েছে। এর বাস্তবায়ন জরুরি। সম্প্রতি উচ্চতর ন্যায়ালয়ের আপিল বিভাগ স্বঘোষিত ‘দানবীর’ রাগিব আলীর চাঞ্চল্যকর চা-শিল্পের জন্য বরাদ্দ ভূমিকে বেআইনিভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান, দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করে গৃহনির্মাণের বেআইনি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস দখল করে মধুবন বাজার স্থাপনের ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে যে যথার্থ রায় ঘোষণা করেছে এর আশু বাস্তবায়ন জরুরি। এতে ভূমিখেকো এবং জলাধার দখলকারীদের আইনের শাসনে এনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা জোরদার হবে। দেশের শতকরা ৭৩ ভাগ লোক বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে আস্থাশীল। এ ধারা বজায় রাখতে হবে।
একটি দক্ষ, চৌকষ, স্বচ্ছ, সৎ ও ন্যায়ের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম সরকারি কর্মকর্তা কর্মাচারী গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাহসী সরকার অষ্টম বেতন কাঠামোতে শ্রেণিবৈষম্য দূর করে বেতন প্রায় দ্বিগুণ করেছে এবং অন্যান্য যুক্তিগ্রাহ্যের ও অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেছে। দেখা দিয়েছে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। ক্যাডার-নন্ ক্যাডার ইস্যু ও শিক্ষকমণ্ডলীর যেসব দাবি ন্যায়সঙ্গত, যেমন অধ্যাপকবৃন্দকে দ্বিতীয় গ্রেডে / স্কেলে (সপ্তম বেতন কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেড / স্কেলে ছিলেন) অবস্থান দিয়ে পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতির মাধ্যমে প্রথম গ্রেডে যাওয়ার ব্যবস্থা করে এ অভূতপূর্ব উদ্যোগের সুফল পূর্ণভাবে ঘরে তোলা সম্ভব ও উচিত হবে। ক্যাডার-নন ক্যাডার ইস্যুটি অহেতুক সৃষ্টি করা হয়েছে; এটি খুব সহজেই সমাধান করা যায়। কল্যাণ রাষ্ট্রে গণকর্মচারী ও স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মিলে প্রায় ২৪ লাখ লোক কর্মরত। অর্থাৎ এক কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বেতন ভাতা ছাড়াও সরকারি প্রিমিয়ামে স্বাস্থ্য ও জীবন বিমা, ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক হওয়া, প্রস্তাবিত সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংকে শেয়ার মালিক হওয়া, অধিকতর পেনশন সুবিধা, বৈশাখী ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে শেখ হাসিনা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
২০১৬ সালের তিনশ ছেষট্টি দিনের প্রথম দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যার্থিদের হাসিমুখ বিজয় উৎসবে ৩৩ (তেত্রিশ) কোটি বই বিনামূল্যে পৌঁছে গেছে। ২০১৬ সালে আরও উন্নতি ঘটুক ঈর্ষণীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের অগ্রগতিতে। তবে গ্যাসের ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই অলাভজনক; এর বদলে গ্যাস দিয়ে শিল্পায়নে যেতে হবে। বন্ধু প্রতিবেশী ভারত, নেপালের উপ আঞ্চলিক সহযোগিতায় বৃহৎ পরিসরে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নামতে হবে। সম্পন্ন করা যেতে পারে পুর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান সংবলিত রূপপুর আনবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আহরণ ২০১৯ সালের মধ্যেই। ২০২৫ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ ও অন্যান্য নবায়ণযোগ্য উৎস থেকে শতকরা ১০ (দশ) ভাগ বিদ্যুৎ আহরণসহ মোট ৩০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কর্মসংস্থান তথা দারিদ্র্য নিরসনের উপায় হিসাবে ব্যাপক শিল্পায়ন প্রচেষ্টা সফল হবে। উল্লেখ্য, যে, বস্ত্রশিল্পে বিপুল প্রচেষ্টা প্রয়োজন যাতে উন্নত মানের আধুনিক প্ল্যান্টে সুতা কাটা ও কাপড় বুননে গতি আসে। পর্যাপ্ত গ্যাসও ২২০ ভল্টেজ বিদ্যুতের উচিত মূল্যে অর্থাৎ বর্তমান দরের দ্বিগুণ মূল্যে দিতে পারলেও এ খাত ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে বিপ্লব আনতে পারবে। কাঁচা তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ-ভালো লক্ষণ বৈকী! তবে সরকারিভাবে সেন্ট্রাল অ্যাপলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে বড় বড় বস্ত্র মিলকে ভাড়ায় সার্ভিস দিতে হতে পারে। শিল্পায়নে ওষুধ, চামড়া, খেলাধুলার সরঞ্জাম, হালকা যন্ত্রপাতি, রাবার, জাহাজ নির্মাণ, মোটরসাইকেল, ফলভিত্তিক খাদ্য, আলু প্রক্রিয়াজাতকারী খাদ্যপণ্য, বাইসাইকেল, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স, হ্যান্ডিক্রাফ্টস, প্রসাধনী ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। স্মর্তব্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুরোনো জাহাজ আমদানিতে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পরিবেশ সুরক্ষা সচেতনাসহকারে অগ্রসর হলে জাহাজভাঙা শিল্পে সম্প্রসারণ ঘটিয়ে স্থানীয় মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পাটের থলে ব্যবহারে খুবই কড়াকড়ি করতে হবে; সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে পলিথিন ব্যাগ। উৎপাদন ও রপ্তানিতে বহুমাত্রিকতা আনা হোক ২০১৬ সাল থেকেই। রেলের ব্রডগেজীকরণ, ডাবল ট্রেকিং ও বিদ্যুতায়নও শুরু হউক নতুন বছরেই।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন খুবই চড়া ছিল, তখন বিপুল পরিমাণ সরকারি ভর্তুকি দিয়ে অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, লুব্রিকেন্ট অয়েল ও কেরোসিন জনগণের নাগালে রাখা হয়। এখন সাময়িকভাবে দাম কমেছে তেলের। তাই উচ্চমূল্য সাধারণভাবে বজায় রেখে বিপিসির বিপুল অতীত ঘাটতি পরিশোধ ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠানটির ইকুইটি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন যাতে এটিকে লাভজনকভাবে চালানো যায়। তবে কেরোসিনের মূল্য যতটুকু সম্ভব তার চেয়েও বেশি কমানো যায়। ইচ্ছা থাকলেও মাল পরিবহণে এবং সেচে ডিজেলের মূল্য কমানো কঠিন হতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবেশী দেশের তুলনায় তেল ডিজেলের দাম বাংলাদেশে কমানো সমীচীন হবে না। এটাও ভাবা দরকার যে ভবিষ্যতে আবারও তেল ডিজেলের দাম বাড়তে পারে। তবে বর্তমান সুযোগে সিএনজির মূল্য বাড়িয়ে পেট্রলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা যেতে পারে। ট্যানারি শিল্প যেন সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে; একে কার্যকর করার জন্য সব পদক্ষেপ আরও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হোক।
আশু করণীয়
গোল্ডম্যান স্যাকস যখন বাংলাদেশকে নেক্সট ইলেভেন হিসাবে ঘোষণা করেন তখন তারা বলেছিলেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ ১১টি দেশের অর্থনীতি ইউরোপের ২৭টি দেশের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে তেমন কোনো সুসংবাদ দিতে না পারলেও বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের ২০১৫ সালের অর্জন এবং পরবর্তী তিন বছরের সমষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রদান করেছে এইভাবে :
দক্ষিণ এশিয়ার কার কত প্রবৃদ্ধি (সমষ্টিক আয়ের শতাংশ হিসাবে)
দেশ ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮
ভারত ৭.৩ ৭.৭ ৭.৯ ৭.৯
বাংলাদেশ ৬.৬ ৬.৮ ৬.৮ ৬.৮
ভুটান ৬.৮ ৭.২ ৫.৬ ৬.০
শ্রীলংকা ৫.৩ ৫.৬ ৬.০ ৬.০
পাকিস্তান ৫.৫ ৫.৫ ৫.৪ ৫.৪
মালদ্বীপ ৪.৪ ৩.১ ৪.২ ৪.৬
নেপাল ২.৬ ৩.৭ ৫.১ ৪.৫
আফগানিস্তান ১.৯ ৩.১ ৩.৯ ৫.০
এসব হিসাব-নিকাশকে বেকায়দায় ফেলে দেয় সর্বগ্রাসী ভয়ংকর কোভিড-১৯। জনবন্ধু শেখ হাসিনার সাহসী, উদ্বাবনী ও জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপের ফলে করোনা অতিমারি অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম ক্ষতির মধ্যেই সীমিত রাখা গেছে। আইএমএফ-এর হিসাবমতে বাংলাদেশ বিশ্বের গুটিকয়েক ইতিবাচক সমষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। মাথাপিছু জিডিপি এখন ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশকে তবে যেতে হবে আরও বহুদূর।
প্রথমেই প্রয়োজন বাহাত্তরের আদলে একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন সৃষ্টি করা যার মাধ্যমে শুধু দেশীয় নয় বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত (integrated) কর্মকাণ্ডের প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে দক্ষ বস্তুগত ও সর্বোত্তম সম্পদ নিয়োজনে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা যাবে। বাংলাদেশে প্রকল্প পরিবীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে দুর্বলতা অতি স্পষ্ট। টাকার অঙ্কে নয় কোন প্রকল্পে কোন সময় কত অংশ ব্যয় হয়ে কত পরিমাণ প্রকৃত (physical) অগ্রগতি হয়েছে তার পরিমাপ করার পদ্ধতি চালু করা বা জোরদার করা যায়। শুরুতে সর্ববৃহৎ বিশটি প্রকল্প চিহ্নিত করে মালয়েশিয়া ও মিসরের মতো প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সপ্তাহভিত্তিক পরিমাপ করে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও দূরীকরণের দিক নির্দেশনা নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে পিপিপি ব্যবহার সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা ইতিবাচক। সব মেগাপ্রকল্প শুরু করার আগে একটি প্রি-ফিজিবিলিটি নিরীক্ষা করা যেতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাকস, জে পি মর্গান, সিএনএন মানিগ্রাম, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন, দ্য ইকোনমিস্ট, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য সিটি গ্রুপ, বিসিজি, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, যোসেফ স্টিগলিজ, অমর্ত্য সেন ও অন্যরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তার রূপায়ণে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বিনিয়োগ করা প্রয়োজন অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে। বাংলাদেশে এখন জাতীয় সঞ্চয় সমষ্টিক আয়ের শতকরা ৩১ ভাগ হলেও বিনিয়োগ হচ্ছে সমষ্টিক আয়ের শতকরা ২৯ ভাগ। সঞ্চয় বেশি বিনিয়োগ কম এ রহস্য ধাধার অন্যতম বড় কারণ সম্পদ ও মূলধন পাচার। ওয়াশিংটনের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি জিএফআই হিসাব করেছে যে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ এ নয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫৮৮ কোটি ডলারের মূলধন বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। তন্মধ্যে শুধু ২০১৩ সালে এ পাচারের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ডলার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এনবিআরের তীক্ষ্ণ পরিবীক্ষণ মাধ্যমে এ মূলধন পাচারের পরিমাণ হয়তো বা হ্রাস করা যাবে। কিন্তু সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ হবে বিনিয়োগ, মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতির বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করে সম্প্রসারণশীল বিনিয়োগ বান্ধবতা নিশ্চিত করা। নীতি কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন করে ব্যক্তি খাতে স্বদেশে বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব এবং উচিত। পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পেতে হলে অজনপ্রিয় বৃহৎ পরিসরের সংস্কার প্রয়োজন। ২০০৯-১০ সালে অযোগ্য বা অবহেলাজনিত কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনসাধারণের আমানতকে ঝুঁকিপূর্ণ তাও আবার সেকেন্ডারি শেয়ারে সিডিআর সীমা অতিক্রম করে তফসিলি ব্যাংকের শিল্প নারী উদ্যোগ ও শিশু উন্নয়ন ঋণের ডাইভারশন রোধ করতে পারেনি। সে ধকল ও বিপর্যয় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্তদের আস্থাহীনতায় রাখছে এর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। শতকরা দুই ভাগ ইকুইটি না থাকলে কেউ করপোরেট কোম্পানিতে পরিচালক হতে পারবেন না-এ বিধান অযৌক্তিক এবং বিনিয়োগ প্রতিবন্ধক; পুনর্বিবেচনা ও রদ করা সুপারিশ করা হচ্ছে। বুক বিল্ডিং মেথডের হেরফের, সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের ফাঁকফোকর এবং ‘প্লেসমেন্ট’-এর গুরুতর ক্ষতি থেকে মূলধন বাজারকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। ‘ইন্ডেপেন্ডেন্ট’ পরিচালক চয়নে ব্যর্থতা এবং মুখ্য নির্বাহীকে পরিচালনা পর্ষদের অধীনস্ত করে রাখলে মূলধন বাজার হয়তো বা কখনোই সুস্থধারায় ফিরবে না। আধুনিক যুগের মোক্ষম একটি সম্পদ কমডিটি এক্সচেঞ্জ স্থাপনের যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব পাঁচ বছর ধরে হিমাগারে কেন?
বাংলাদেশে আরও দ্রুতগতি সমষ্টিক আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স উত্তরোত্তর বৃহত্তর ভূমিকা রাখবে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন ও রপ্তানিতে সজ্ঞান বহুমাত্রিকতা আনা ছাড়াও তৈরি পোশাক ও নিট অয়্যারে নতুন নতুন রপ্তানি গন্তব্যের সন্ধান আরও জোরদার করা সমীচীন হবে। এসব পণ্যের উপরিভাগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম উন্নততর ডিজাইন ও তৈরি পোশাকে যেতে হবে। স্মরণ রাখা ভালো যে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট বিএসটিআই কে যত শিগ্গির সম্ভব একটি বিশ্বমানের প্রত্যয়নকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা জরুরি। এটার প্রত্যয়নপত্র যেন পণ্য ও সেবা রপ্তানিতে বিনাদ্বিধায় সব রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করে সে ব্যবস্থা করা যেতেই পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে দেশে এখনো যে পরিমাণ দরিদ্র এবং বেকার মানুষ রয়েছেন, তাতে যে কোন উন্নয়ন পথ পরিক্রমায় শিল্প স্থাপনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে আনতে হবে। বড় বড় শিল্প কলকারখানা বার্ষিক সমষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধিকে দ্রুততর করবে এবং উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করা হলে পশ্চাৎমুখী সংযোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তবে গ্রামবাংলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে কুটির, অতিক্ষুদ্র (Micro), ক্ষুদ্র (Small), মাঝারি (Medium) উদ্যোগ (Enterprise) CMSME । স্থানীয় কাঁচামাল, স্বল্প মূলধন, অত্যন্ত সরল প্রযুক্তি, আমদানি খরচ তেমন নেই, স্বল্পকালীন প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ এমএসএমই উদ্যোগে কৃষিজাত পণ্যের শিল্প প্রক্রিয়াজাত করা হলে বিপুল কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় যুবক ও যুব মহিলারা বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে এসব উদ্যোগ চালাবে। আয় রোজগার মাধ্যমে পরিবারের দারিদ্র্য দূর হবে। বৃহত্তর ও মজবুত হবে টেকসই মানব উন্নয়নের ভিত্তি। এসব উদ্যোগে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার হবে। দেওয়া যেতে পারে প্রণোদনামূলক অত্যন্ত সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদের ঋণ। উদ্যোক্তা তৈরির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনকিউবেটর স্থাপন করা যেতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে কর্মসংস্থানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে ক্ষুদ্র ও মধ্যম সাইজের শিল্প থেকে। পিকেএসএফ, এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিকের মধ্যে একটিকে এর ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় রাখা যেতে পারে। সংস্কার ও ক্ষমতায়ন এখন সময়ের দাবি যাতে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য কমানোতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
নগরায়ণের সমস্যা এবং ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক জট খুলতে হলে সব কাজের তদারক করার কর্তৃত্বকারী দ্য সিটি গভর্নমেন্ট স্থাপন করার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে মহানগরে আঞ্চলিক স্কুল ভর্তি, স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় বাসে যাতায়াত বাধ্যতামূলক করা, নমনীয়ভাবে ফ্লেক্সিবল অফিস সময় নির্ধারণ করা, কয়েকটি এলাকাকে (যেমন মতিঝিল) যানমুক্ত করা, কয়েকটি রাস্তাকে একমুখী করা, বায়ের লেনের গাড়িকে বায়ে মোড় দিতে বাধ্য করা, মেয়র প্রস্তাবিত পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস মিনিবাসের বদলে ৩০০০ বৃহৎ পরিসর নতুন বাস রাস্তায় আনতে ফিসক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করা, রাজধানীর প্রবেশপথে টোল মেশিন বসিয়ে টোল আদায় করা এবং গাজীপুরে ঢাকার উপশহর নির্মাণ ও দ্রুত সার্কুলার রেল যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি। তবেই বর্তমান সরকারের ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ বিপুল কর্মকাণ্ড শতভাগ সাফল্য এনে দেবে।
অফিস আদালতের সর্বস্তরে বাংলা চালুর বিষয়ে আরও জোরদার অগ্রগতির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশের কোর্ট-কাচারিতে বাংলাভাষা চালু হয়ে গেলেও উচ্চতর ন্যায়ালয়ে এখনো ইংরেজি ভাষায় রায় ঘোষণা করা হয়। আগামী পাঁচ বছরে ২০২১ সাল নাগাদ সব আদালতের রায় বাংলাভাষায় লেখার বিধান চালু করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে যেসব রায়ের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে সেগুলো সম্ভবত ইংরেজিতেও লিখতে হবে। এ ছাড়া আইনের বইগুলোকে বাংলায় রূপান্তর করতে হবে।
দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম অফিসিয়ালি মূলত বাংলা হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি, মেডিকেল এবং অন্যান্য শিক্ষার মাধ্যম এখনো ইংরেজি। এ ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় আরও ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার যে ইংরেজি বা অনুরূপ অন্যান্য আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত ভাষা এখন শুধুই একটি ভাষা নয় বরং এ গুরুত্ব এখন টেকনলজি এমনকি উৎপাদনের উপাদানের (factor of
production) মতো। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারে ইংরেজি ভাষার সব প্রয়োজনীয় মূল জ্ঞানের আঁধার বইগুলোকে প্রথমেই বাংলায় অনুবাদ করে নিতে হবে। নইলে দর্শন, ইতিহাস, গণিত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে যে জ্ঞান ভান্ডার ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার বইতে সংরক্ষিত রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত রেখে উচ্চশিক্ষার্থীদের সত্যিকারভাবে জ্ঞানী করে তোলা যাবে না। তাই ২০২১ সনের মধ্যে বিদেশি ভাষার বইগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে এবং বাংলাভাষায় মূল বই প্রণয়ন করিয়ে উচ্চশিক্ষায় বাংলাভাষার প্রচলন বাধ্যতামূলক করার পথ করা যেতে পারে।
শেষের কথা
বাংলাদেশ সার্ভে অব পাবলিক অপিনিয়ন শিরোনামে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য জরিপ প্রতিষ্ঠান নিয়েলসন বাংলাদেশকে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা চালিয়েছে। দৈবচয়নে ২৫৫০ জন উত্তরদাতার কাছ থেকে ৩০ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রশ্নোত্তর চাওয়া হয় সারা দেশে। তার মধ্যে শতকরা ৪৩ জন উত্তর দেন। সমীক্ষার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিচ্ছে বলে মনে করার যুক্তিসঙ্গত উপাদান পাওয়া যায়। দেশ সঠিক পথে নাকি বেঠিক পথে চালিত হচ্ছে এ রকম প্রশ্নের জবাবে নভেম্বর ২০১৩ তারিখে ৩৩ শতাংশ উত্তরদাতা সঠিক পথে ও ৬২ শতাংশ বেঠিক পথের মূল্যায়ন দিয়েছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় নভেম্বর ২০১৫ তারিখে সঠিকের অনুপাত ৬৪ ভাগে উঠে আসে এবং বেঠিকের অনুপাত নামতে নামতে শতকরা ৩২ ভাগে হ্রাস পায়। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সম্প্রতি সঠিকপথে চলার মূল্যায়নকারী উত্তরদাতারা এর জন্য শিক্ষার অগ্রগতিকে কৃতিত্ব দিয়েছেন (শতকরা ৭২ জন)। আর বেঠিক পথে চলার উত্তরদাতাগণের মধ্যে শতকরা ৪৮ ভাগ দায়ী করেছেন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে; তবে মাত্র শতকরা এক ভাগ মনে করেন যে একতরফা সরকার এ জন্য দায়ী। নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভালো ও মোটামুটি ভালো হিসাবে শতকরা ৬৭ জন মত দিলেও নভেম্বর ২০১৫ সালে এটি বেড়ে শতকরা ৮০ ভাগে উঠে আসে। রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত স্থিতিশীল ও মোটামুটি স্থিতিশীল সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে ছিল শতকরা ৫৯ আর নভেম্বর ২০১৫-তে এটা বেড়ে শতকরা ৭০-এ উঠে আসে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করছেন ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী যা নভেম্বর ২০১৫ সালে ছিল শতকরা ৭৯ ভাগ; আর গত এক বছরে অবস্থার উন্নতি দেখছেন শতকরা ৬৫ জন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বনাম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিতর্কে গণতন্ত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা উত্তরদাতাদের পরিমাণ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে ছিল ৫৮ ভাগ আর নভেম্বর ২০১৫-তে এ অনুপাত শতকরা ৪৩ ভাগে নেমে আসে। সমৃদ্ধির স্বার্থে গণতন্ত্রের খানিকটা কমতি এখনো লোক মেনে নিচ্ছে।
২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতবর্ষের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ল অব দ্য সি ট্রাইব্যুনালে সমুদ্রসীমা জেতার পর এক লাখ উনিশ হাজার বর্গকিলোমিটারের কিছু বেশি এলাকা বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত হয়। মালিকানা মিলে সমুদ্রসীমা এবং মহীসোপানে। উন্মুক্ত হয়েছে সুনীল অর্থনীতি বিকাশ করে বিবিধ সম্পদ তেল, গ্যাস, অন্যান্য খনিজ, মৎস্য, ওষুধ প্রস্তুতের উপকরণ, জাহাজ চলাচল সুবিধা ও পর্যটন সম্ভার আহরণ করে দেশের উঠতি প্রবৃদ্ধির হারকে আরও বেগবান করা। এ জন্য অবশ্যই সমুদ্রসীমা পাহারা ও সংরক্ষণের জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অনেক শক্তি সংযুক্ত করতে হবে, ক্ষমতায়িত পরিকল্পনা কমিশনের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে সমন্বিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রোগ্রাম ও প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৌশল নির্দ্ধারণ করা জরুরি। উচ্চশিক্ষায় সুনীল অর্থনীতি বিষয়ের সব দিক নিয়ে জ্ঞান আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে।
বিগত চার দশকে সমুদ্র ও উপকূল সীমানায় অনেক ভাঙাগড়ার নিট ফলশ্রুতিতে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি সংযুক্ত হয়েছে বাংলার আয়তনে। প্রতি বছর এখনো ভূমিখণ্ড জেগে উঠছে। এ বিষয়ে শ্রম, কৌশল, সম্পদ ও মনোযোগ দিতে পারলে বাংলাদেশের ভৌগলিক আয়তন আরও বেশ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। পৃথিবীর সর্বনিু মাথাপিছু ভূমির দেশে নতুন এলাকা স্বস্তি আনবে এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ধারাতে যথেষ্ট অতিরিক্ত শক্তি জোগাতে পারবে বৈকী!
দেশের পরম সৌভাগ্য, নেতৃত্ব যার হাতে তিনি জনস্রোতের উজানে গিয়ে জনমত ধারাকে সম্পূর্ণভাবে ঘুরিয়ে দিয়ে তার পেছনে আনার ক্ষমতা রাখেন। সে উদ্ভাবনী বলিষ্ঠ নেতার অনুসারী হয়ে ২০২১ সালে সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও গৌরব মহিমার শিখরে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ যাত্রার এখনই সময়।