পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে ত্রিমুখী চাপে ছাত্রলীগ

image-169743-1555967446

পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা নিয়ে ত্রিমুখী চাপে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। কমিটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ দিনের আলটিমেটাম শেষ হয়েছে সোমবার।

কমিটি গঠনে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের দফায় দফায় বৈঠক, ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষে দেয়া ১২ ঘণ্টার সময়সীমাও পার হয়েছে। এদিকে সর্বোচ্চ মহলের এ চাপের মধ্যেই বিকল্প পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুতির দায়িত্ব পেয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন।

এতে আরও বেকায়দায় পড়েছেন ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।

আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দু’বার ফেরত এসেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। তাদের জমা দেয়া কমিটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা তালিকার বিশাল ফারাক থাকায় ফেরত আসতে হয়েছে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন তাদের। কিন্তু এককভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দিয়ে ফের তোপের মুখে পড়েন শোভন-রাব্বানী

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পরামর্শে একটি বিকল্প কমিটি প্রস্তুত রেখেছে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বায়োডাটা জমা পড়া নেতাদের থেকেই এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে বলে সাবেক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী দেশের ফেরার আগেই (বুধবারের মধ্যে) শোভন-রাব্বানী সঠিক তালিকা জমা দিতে ব্যর্থ হলে বিকল্প এ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া হতে পারে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোহাগ-জাকির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটির কাজ শেষের দিকে। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। সেটা প্রায় কাটিয়ে ওঠেছে। আশা করি প্রধানমন্ত্রী ব্রুনাই থেকে দেশে এসেই তালিকা ঘোষণা করবেন।

দায়িত্বে থাকার আরেক নেতা ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, তাদের জমা দেয়া তালিকায় কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। আমরা ১২ ঘণ্টার সময় দিয়েছি। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।

গত বছরের ১১-১২ মে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের আড়াই মাস পর (৩১ জুলাই) সভাপতির পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম রাব্বানীর নাম ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট হওয়ার কথা।

রীতি অনুযায়ী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কথা। কিন্তু দুই সদস্যের এ কমিটির মেয়াদ ১০ মাস পার হতে চললেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে কোনো উদ্যোগই নিতে পারেননি শোভন-রাব্বানী। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ছাত্রলীগের ভ্যানগার্ড প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ করতে বাধ্য হয় তারা।

এনিয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতা ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন। কমিটি গঠনে আলটিমেটামও দেন কয়েকবার। সর্বশেষ বেঁধে দেয়া ৭ দিনের আলটিমেটামও শেষ হয়েছে সোমবার।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ৭ দিনের মধ্যে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় নেতাদের তাগিদ দেন। ১৬ এপ্রিল রাতে দলের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা দেখা করতে গণভবনে গেলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাদের এ তাগিদ দেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সে আলটিমেটামের মেয়াদ সোমবার শেষ হয়েছে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, শুক্রবার আওয়ামী লীগের যৌথসভা শেষে রাতে ধানমণ্ডির কার্যালয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন দলটির চার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা।

এ সময় পূর্ণাঙ্গ কমিটি সমন্বয়ের জন্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের চার নেতা হলেন- দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহা উদ্দিন নাছিম ও বিএম মোজাম্মেল হক।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ ছিল সাবেক কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে সমন্বয় করা। সমন্বয় করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বৈঠকে কোনো উত্তর না দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে মাথা নিচু করে চুপ ছিলেন শোভন-রাব্বানী। বৈঠকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুত করতে শোভন-রাব্বানীকে আলটিমেটাম দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

পরদিন রাতে একই স্থানে ফের বৈঠকে বসেন তারা। বৈঠকে শোভন-রাব্বানীর উপস্থাপিত তালিকায় বেশ গরমিল চোখে পড়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের। পরে ১২ ঘণ্টার সময় দিয়ে তালিকা সংশোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। সে সময়ও সোমবার শেষ হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত তালিকা জমা দিতে পারেনি ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।

এদিকে ছাত্রলীগের এবারের সম্মেলনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকায় সম্মেলনে কাউন্সিলররা নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন না করে কমিটি গঠনের পুরো দায়িত্ব আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর অর্পণ করেন। এছাড়া দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা একটি কথিত সিন্ডিকেট ভাঙতে এ বিকল্প সিদ্ধান্তও বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের অনেকেই।

আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে ছাত্রলীগের কমিটির গঠনের দায়িত্বভার অর্পণের পরপরই বায়োডাটা জমার হিড়িক পড়ে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে ৩২৩ জন আবেদন করেন। এরপর সবাইকে ৪ জুলাই গণভবনে ডাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যোগ্যদের কমিটির বাইরে রাখার পাঁয়তারা করছেন। তারা ভাই লীগ গঠনে কর্মী নয় এমন ছেলে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রস্তুত করছে। তারা বলেন, আমাদের অপরাধ আমরা ছাত্রলীগ বলতে শুধুই ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনাকে বুঝি। কিন্তু কমিটিতে স্থান পেতে তাদের প্রথম শর্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী হতে হবে, তাদের বলয়ে থাকতে হবে, তাদের পেছনে ঘুরতে হবে। এখন রাত জেগে নানা অনিয়মের মাধ্যমে যেনতেনভাবে তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ করেন পদবঞ্চিতরা।

তবে অভিযোগের সত্যতা জানতে বুধবার বারবার ফোনে চেষ্টা করলেও কল রিসিভ করেননি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।

Pin It