বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ভেঙে হচ্ছে আরও দুই জোট

image-626649-1671450450

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট ভাঙা-গড়ার রাজনীতি চলছে। চলছে নতুন মেরুকরণ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট বর্তমানে নিষ্ক্রিয়।

কয়েকদিন আগে এই জোটের কয়েকটি দলের সঙ্গে নতুন কয়েকটি দল যুক্ত হয়ে গঠন করা হয়েছে ৭ দলের ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। এখন ১২ দল মিলে গঠন করা হচ্ছে ‘জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট’। বৃহস্পতিবার এই জোটের আত্মপ্রকাশ হবে। এ মাসেই নতুন সাতটি দল মিলে ঘোষণা আসছে আরও একটি জোটের। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটেও আছে টানাপোড়েন।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এখন আর নেই। এমনটাই বললেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘নতুন জোট যেগুলো হচ্ছে আমরা তাদের স্বাগত জানাই। আমাদের সবার লক্ষ্য অভিন্ন। পৃথক প্লাটফরম থেকে আমরা ঐক্যভাবে আন্দোলন করব। সবার উদ্দেশ্য সরকারের পতন ঘটানো।’

বিএনপি

বৃহস্পতিবার যে জোটটি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট’। সমমনা ১২ দল মিলে গঠন করা হচ্ছে এই জোট। এই জোটের শরিক দলগুলোর সবাই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ছিল। এছাড়া আগামী ৩০ ডিসেম্বর সমমনা ৭ দল মিলে নতুন একটি জোট গঠন করছে। তবে এসব জোটের কোনটিতেই থাকছে না প্রধান শরিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি।

নতুন জোটে যাচ্ছে যেসব দল

নতুন এই জোটের দলগুলো হচ্ছে-মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, কে এম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে এলডিপি (একাংশ), অ্যাডভোকেট জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, অ্যাডভোকেট আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা, একাংশ)।

এই জোটের নেতৃত্বে থাকবেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার। মুখপাত্র হিসেবে থাকবেন মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। গণমাধ্যম বিষয়ে সমন্বয় করবেন শাহাদাত হোসেন সেলিম।

নতুন জোটের বিষয়ে জানতে চাইলে মুখপাত্র মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, ‘আমরা ১২ টি দল মিলেই এই জোট গঠন করতে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার ইনশাল্লাহ আমরা জোটের নাম ঘোষণা করব। যুগপৎ আন্দোলনে আমাদের সবার অবদান থাকবে। কিন্তু সেটাকে আরও সুসঙ্গতভাবে করার জন্য একতাবদ্ধ হতে চাচ্ছি। মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলন, শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পতনের আন্দোলন। বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের যে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে, তার সঙ্গে অনেকাংশে ঐকমত্য রয়েছে আমাদের। আমাদের সবার লক্ষ্য এক ও অভিন্ন।’

জানা গেছে, সম্প্রতি গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চের আদলেই চলমান যুগপৎ আন্দোলনে পৃথক মঞ্চ থেকে অংশ নেবে সবাই। নতুন জোটের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হবে ২০ দলীয় জোট। সূত্র মতে, নতুন কৌশল হিসেবে বিএনপির ‘গ্রিন সিগন্যাল’ নিয়েই জোট দুটি গঠিত হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত থেকেই এ কৌশল নিয়েছে তারা। সে লক্ষ্যে এবার বিএনপি একক মঞ্চ থেকে আন্দোলন করছে। কোনো জোটভুক্ত আন্দোলন করছে না এবং নতুন জোটও গঠন করেনি। দলটির সে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা নিজেদের পছন্দের মতো জোটবদ্ধ হচ্ছেন। তবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্য দলগুলো জোটবদ্ধ হতে রাজি নয়।

আসছে নতুন ৭ দলীয় জোট

জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটের শরিক সাতটি দলের পৃথক জোট গঠনে শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। সম্ভাব্য এ জোটের শীর্ষ নেতা হচ্ছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। বৃহস্পতিবার ১২ দলীয় জোট আত্মপ্রকাশের পর এ জোটটির নাম ও আত্মপ্রকাশের তারিখ চূড়ান্ত হবে। তবে প্রাথমিকভাবে ৩০ ডিসেম্বরকে মাথায় রেখেই তারা এগুচ্ছে।

এই জোটে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ছাড়াও থাকবে অ্যাডভোকেট মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট, সাদেক শাওনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা, একাংশ), অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী), সাইফুদ্দীন মনির নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল) ও অ্যাডভোকেট গরীবে নেওয়াজের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পিপলস লীগ।

বিএনপির এই জোটের রাজনীতিকে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে? জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপির প্রধান এখন কে? তার বিরুদ্ধে তো চুরি, লুটতরাজের মামলায় আদালত সাজা দিয়েছে। ফলে তাদের নিয়ে এখন আওয়ামী লীগ ভাবে না। তারা রাষ্ট্র সংস্কারের যে ২৭ দফার রূপরেখা দিয়েছে সেটা হাস্যকর। যে দল নিজেরাই সংস্কার হতে পারে না, তারা রাষ্ট্র সংস্কার করবে কীভাবে। দেশ থেকে টাকা পাচারের সঙ্গে তো তারাই জড়িত। ফলে তারা ক্ষমতায় গেলে আবারও দেশে লুটপাটের রাজনীতি করবে। আর তাদের সঙ্গে যারা আছে, তাদের তো আওয়ামী লীগ কোনো দল হিসেবেই মনে করে না।’

বিএনপির ডাকে ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের মাধ্যমে শুরু হচ্ছে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন। সেদিন বিএনপি ছাড়াও আরও ৩৬টি রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলনে রাজপথে থাকবে। তারা চারটি প্ল্যাটফর্মে আলাদা মোর্চা গঠন করে বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।

টানাপোড়েন ১৪ দলীয় জোটেও

গত সোমবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন প্রাঙ্গণে মহান বিজয় দিবস ও শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে এক আলোচনাসভায় আয়োজন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। জোটের শীর্ষ নেতারা এই আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকবেন আগে থেকে এমন কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন না বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। শীর্ষ এই দুই নেতার অনুপস্থিতি নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। জোটের টানাপোড়েনের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।

কিছুদিন আগে থেকেই ২০১৮ সালের ভোটসহ সরকারের নানা সমালোচনায় সরব ছিলেন রাশেদ খান মেনন। আবার সরকারবিরোধী নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। ফলে সরকার দলীয় জোটও যে স্বাভাবিকভাবে চলছে এমনটি নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জোটের শরিকদের কোন মন্ত্রীত্ব দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে জোটের শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের উপর বেশ অখুশি।

তবে টানাপোড়েনের কথা সরাসরি স্বীকার করতে চাননি কোন নেতা। বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনাসভায় কেন যাননি? জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমার ঢাকার বাইরে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সে কারণে যেতে পারেনি।’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কে কী কোন টানাপোড়ের চলছে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের মধ্যে কোন টানাপোড়েন নেই।’

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সমীর কুমার দে। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

Pin It