বিপুল ব্যয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও আয়ের সামর্থ্য কম: বিএনপি

fakhrul-5d0394be58a34

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিপুল ব্যয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সরকারের আয়ের সামর্থ্য  কমে গেছে বলে মনে করছে বিএনপি।

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিপুল অংকের ব্যয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সরকারের আয়ের সামর্থ্য কমে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা ও নাজুক আর্থিক খাত।’

অর্থমন্ত্রী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার ‘উচ্চাভিলাষী বাজেট’ ঘোষণা করেছেন– মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেটের আকার বড় করার চমক সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন যেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেট বৃদ্ধির এ প্রগলভতা বছর শেষে চুপসে যেতে দেখা যায়। বাজেটের আকার কত বড় এ নিয়ে আর জনমনে কোনো উচ্ছাস নেই।’

তিনি বলেন, ‘মোট রাজস্বের মধ্যে বড় অংশ হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। আগামী ১ জুলাই থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক আইন ২০১২ কার্যকর করা হবে। নতুন আইনে ভ্যাটের স্তর থাকবে ৫টি। এই স্তরভিত্তিক ভ্যাট হার অনেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যবসায়ীরা রেয়াত নিতে না পারলে এটি আবগারি শুল্কের মতো হয়ে যেতে পারে। রেয়াতের টাকা কীভাবে দেয়া হবে সেই বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আইনে ব্যবসায়ীরা রেয়াত চাইতে শুরু করলে সরকারকে নিজের পকেটের টাকা দিতে হবে। এ জন্য বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে যেতে পারে। সরকারের পক্ষে যদি ভ্যাটের রেয়াতের টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব না হয় তবে ভ্যাট কার্যত আবগারি শুল্কে পরিণত হবে। এতে করের ওপর আবার কর আরোপ হবে। ফলে জিনিসপত্রের দাম সাড়ে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, যার চাপ পড়বে সম্পূর্ণ ভোক্তার ওপর।’

ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সুদ-আসল পরিশোধ করতেই বিশাল ব্যয় হচ্ছে– উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের গুণগত সার্বিক রূপান্তরে অত্যধিক প্রয়োজনীয় মানব পুঁজি বা দক্ষ শ্রমশক্তি বিনির্মাণে, তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। উপরন্তু ঋণের পরিমাণ সুদসহ জমতে জমতে পাহাড়সম হলেও পরিশোধের কোনো দিকনির্দেশনা এই বাজেটে নেই। বলা বাহুল্য, এর দায়ভার চাপবে ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর।’

তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বারবার সংশোধনের ফলে ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চার লেন সড়ক তৈরিতে যেখানে ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৫০ লাখের বেশি। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বালিশ দুর্নীতির যে খবর জনসম্মুখে এসেছে তাকে হিমবাহের চূড়া বলা যেতে পারে।’

প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা করা হয়েছে। যদিও অর্থবছরের শুরুতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যা প্রশ্নবিদ্ধ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির ইনডেক্সগুলোর কোনো সামঞ্জস্য নেই। ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলে রফতানি বাণিজ্য, শিল্প প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বেকারত্ব যে হারে হ্রাস পাওয়ার কথা বাস্তব চিত্র তার চেয়ে ভিন্ন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ কেন সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সলিল সমাধি হচ্ছে? দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অবস্থান ইতোমধ্যে নেতিবাচক অবস্থায় চলে গেছে। লেনদেনের ভারসাম্য নিদারুণ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। শিক্ষা খাত প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সংখ্যায় বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মানে ধস নেমেছে। শিক্ষা খাতে ব্যয় মোট জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশেরও কম। স্বাস্থ্য খাতে ১ শতাংশেরও কম। মানবসম্পদ আশানুরূপভাবে উন্নত হয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে করের টাকা দিয়ে ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা হচ্ছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেট শুধু আয় ব্যয়ের হিসেব নয়, আয়ের পুনর্বণ্টনও। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পাশাপাশি আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরের দিকের পাঁচ ও নিচের পাঁচের মধ্যে ২০১০ সালে পার্থক্য ছিল ৩২ গুণ যা ২০১৬ সালে হয়েছে ১২১ গুণ। প্রকৃত অর্থে মানুষের জীবনমানের অনেক অবনতি হয়েছে। সরকার প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর আদায় করছে বেশি। আর পরোক্ষ করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে বেশি। সাধারণ মানুষের অর্থে যে বাজেট তৈরি হয় তার ব্যয় থেকে ধনীদের ভর্তুকি দেয়া হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রাষ্ট্রীয় অর্থে তাদের বেইল আউট করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক। প্রতিবছরই বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হারেও দেখা যায় নিম্নমুখীতা। বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। কোথাও যেন আস্থার অভাব আছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ সরকারই যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় এবং এর ফলে  জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতাও নেই।’

সু-শাসনের অভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বন্ধ, শেয়ার বাজারে অস্থিরতা, ব্যাংকে তারল্য সংকট চলছে। সরকার দেশকে ঋণনির্ভর অর্থনীতির বৃত্তে আবদ্ধ করে রেখেছে। এই ঋণ শোধ দিতে দেশের মানুষের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে।’

তিনি বলেন, অনির্বাচিত সরকারের নৈতিক অধিকার নেই বাজেট দেয়ার। সরকার জনগণকে বাইরে রেখে যেভাবে নির্বাচন করেছে, একইভাবে বাজেটও দিচ্ছে। যেভাবে জনগণ এই নির্বাচন গ্রহণ করেনি, তেমনি বাজেটও তারা গ্রহণ করবে না।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Pin It