শিমুল হত্যা: নিজেকে গ্রেফতারে পুলিশকে ঘুষ

Untitled-10-5d66d1c3694b6

গ্রেফতার এড়াতে পুলিশকে উৎকোচ দেওয়ার ঘটনা হরহামেশাই শোনা যায়। তবে এবার ঘটেছে উল্টো ঘটনা। নিজেদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তুচ্ছ অপরাধের নাটক সাজিয়েছে কালু ও সাহেব আলী নামে হত্যা মামলার দুই আসামি। তারা শাহজাদপুরের বরখাস্ত মেয়র হালিমুল হক মিরুর শটগানের গুলিতে নিহত সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল হত্যা মামলার ৯ ও ১৪ নম্বর আসামি। অনুসন্ধানে এই অপকৌশলের রহস্য উন্মোচন হয়। জানা যায়, সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলাটির বিচারকাজ বিলম্বিত করতেই আসামিপক্ষ এ অভিনব কৌশল নিয়েছে।

মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) এন্তাজুল হক বাবু বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা এখন পরিস্কার যে, আসামিপক্ষ মামলাটির বিচারকাজ পরিকল্পিতভাবে পিছিয়ে নিচ্ছে। দুটি ঘটনাতেই পুলিশকে টাকা দিয়ে আসামিদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। যেন চার্জ গঠন পিছিয়ে যায়।

পিপি জানান, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুযায়ী ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। আসামিপক্ষ চাচ্ছে কালক্ষেপণ করে নির্ধারিত দিন পার করতে। এটা করতে পারলে তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে আবারও সিরাজগঞ্জের আগের আদালতে মামলাটি নিয়ে যেতে চাইবে। এভাবে পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে মামলাটি শেষ হবে না। তিনি আরও বলেন, আমি আদালতকেও বিষয়টি জানিয়েছি। চার্জ গঠন হলে মামলাটি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। তবে আসামিপক্ষ সে সুযোগ দিচ্ছে না।

জানা যায়, মামলাটি রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এলে ৮ আগস্ট চার্জ গঠনের দিন নির্ধারণ করেন বিচারক অনুপ কুমার। তবে সেদিন নিজেদের প্রস্তুতি নেই বলে আদালতে সময় আবেদন করে আসামিপক্ষ। পরে আদালত ১৮ আগস্ট চার্জ গঠনের দিন ধার্য করেন। এরই মধ্যে মেয়র মিরুর স্বজন ও আসামি কালু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা পুলিশকে ঘুষের বিনিময়ে ম্যানেজ করে। ১৭ আগস্ট শিমুল হত্যা মামলার ৯ নম্বর আসামি শাহজাদপুর থানার বাসিন্দা কালুকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার এসআই জিন্নাতুল ইসলাম ও ওসি জিয়াউর রহমান মিলে গ্রেফতার করেন। পরে তাকে ১৫১ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘পাঁচ বা ততোধিক সংখ্যক ব্যক্তির সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করার নির্দেশ প্রদত্ত হওয়ার পর জ্ঞাতসারে উহাতে যোগদান বা অবস্থান করলে ৬ মাস পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলাটি ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শেষ করার কথা রয়েছে। চার্জ গঠনের দিন আদালতে সব আসামির উপস্থিতি প্রয়োজন। তবে এর আগের দিন পুলিশকে টাকা দিয়ে সাধারণ ধারায় আটক হচ্ছে আসামিরা। ফলে বারবার চার্জ গঠনের দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে মামলার বিচারকাজ নির্ধারিত দিনের মধ্যে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

আসামি কালুকে আটকের বিষয়ে এসআই জিন্নাতুল ইসলাম তার দায়ের করা জিডিতে বলেছেন, ১৭ আগস্ট সকাল পৌনে ১০টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তিনি জানতে পারেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার নয়াগোলা মোড়ে অপরাধ সংঘটনের জন্য কতিপয় ব্যক্তি সংগঠিত হয়েছে। পরে তিনি ফোর্স নিয়ে সকাল ১০টায় সেখানে পৌঁছে দেখেন তিন ব্যক্তি সেখানে অবস্থান করছে। পুলিশের উপস্থিতি দেখে দু’জন দৌড়ে পালিয়ে যায়। শুধু শিমুল হত্যার আসামি কালুকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সেখানে অবস্থানের কারণ জানতে চাইলে কালু কোনো উত্তর দিতে পারেনি। পুলিশ তাই তাকে ১৫১ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে বিষয়টির তদন্ত অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় তাকে কারাগারে আটক রাখা প্রয়োজন জানিয়ে আদালতে পাঠান তিনি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে নয়াগোলা মোড়ে একাধিক টিম যায়। তবে ১৭ আগস্ট সকাল পৌনে ১০টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সেখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়া বা কাউকে গ্রেফতার করতে দেখেননি এলাকাবাসী। তারা জানান, সকালে সেখানে পুলিশের কোনো টহল গাড়িও ছিল না। বিকেলে পুলিশের গাড়ির টহল দেখা যায়। তবে তখনও কাউকে আটক করতে দেখা যায়নি। কোনো মারামারি বা হাতাহাতিও হতে দেখেননি তারা। এ নিয়ে স্থানীয়রাই হতভম্ব হয়েছেন। অনেকেই বলেন, শাহজাদপুর থেকে এক ব্যক্তি কী কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসবে? এটা তো পরিস্কার সাজানো নাটক মনে হচ্ছে। এই নাটকটি পুলিশকে ম্যানেজ করেই আসামিপক্ষ সাজিয়েছে।

এ বিষয়ে এসআই জিন্নাতুল ইসলাম বলেন, কোনো টাকার বিনিময়ে কালুকে আটক করিনি। নয়াগোলা মোড়ে তিনজন মারামারি করছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সেখানে যাই। দু’জন দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখন সেখান থেকে কালুকে গ্রেফতার করি।

এলাকাবাসীর কেউ মারামারির দৃশ্য দেখেনি কেন- জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে পারেননি। ১৫ মিনিট ধরে মারামারিতে কেউ আহত হলো না কেন জানতে চাইলে এসআই বলেন, আসলে মারামারি নয়, হাতাহাতি হচ্ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার মতো আহত হয়নি কালু।

১৮ আগস্ট আসামি কালুর অনুপস্থিতির কারণ দেখিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী সময় আবেদন করেন আদালতে। আদালত আবারও চার্জ গঠনের জন্য ২৫ আগস্ট দিন দেন। এদিনও একই ধরনের নাটকের ঘটনা ঘটায় আসামিপক্ষ। এবার তাদের ১৪ নম্বর আসামি সাহেব আলীকে আদালতে হাজির না করে সময় চাওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিমুল হত্যা মামলার ১৪ নম্বর আসামি শাহজাদপুর উপজেলার নলুয়া গ্রামের আজহার আলী প্রামাণিকের ছেলে সাহেব আলী। গত ২৩ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার পৌর এলাকার মুক্তমঞ্চ এলাকা থেকে তাকে ৩৪ ধারায় (একই উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কতিপয় ব্যক্তি একত্রিত হয়ে অপরাধমূলক কাজ সম্পাদন করে এবং এর জন্য প্রত্যেকেই দায়ী হবেন) আটক দেখান ফরিদপুর থানার এসআই মো. কামরুজ্জামান। পরদিন তাকে পাবনার আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এই মামলার চার্জ গঠনের দিন ধার্য ছিল তার পরের দিন রোববার। হত্যা মামলাটির ১৪ নম্বর আসামি সাহেব আলীকে কারাগারে দেখিয়ে আবারও সময় আবেদন করে আসামিপক্ষ। এবার বিচারক তৃতীয় দফায় চার্জ গঠনের তারিখ পিছিয়ে ১ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন ওঠে।

গত সোমবার ফরিদপুরে সরেজমিন অনুসন্ধানকালে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ওঠে। জানা যায়, ফরিদপুর থানার এসএই কামরুজ্জামান, কনস্টেবল শফিকুল ইসলাম ও মো. রুবেল ওই রাতে টহল ডিউটি করছিলেন। সাহেব আলী টাকার বিনিময়ে এসআই কামরুজ্জামানকে ম্যানেজ করে ৩৪ ধারায় আটক হন এবং তাকে পাবনার আদালতে চালান করান। যেহেতু পরদিন সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলার চার্জ গঠনের দিন ছিল। পরে এই অজুহাতে আইনজীবীর মাধ্যমে চার্জ গঠনের তারিখ পরিবর্তনের আবেদন করে আসামিপক্ষ।

ফরিদপুরের মুক্তমঞ্চ এলাকা পরিদর্শনকালে আশপাশের ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ বলেছেন, ওই রাতে তারা কোনো হৈহুল্লোড়ের সাড়াশব্দ পাননি। কাউকে আটক করা হয়েছে- এ ধরনের কোনো খবরও এলাকাবাসী জানেন না।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পাবনার সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী শফিক আল কামাল বলেন, বিষয়টি সন্দেহজনক। ফরিদপুর থানার এসআই কামরুজ্জামান অনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলা বিলম্বিত করতে সাহেব আলীকে আটক করেছেন। যাতে সে রাজশাহীর আদালতে উপস্থিত হতে না পারে।

এ ব্যাপারে ফরিদপুর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ প্রাথমিকভাবে বলেন, সাহেব আলী নামের কাউকে আটক করা হয়েছে কি-না তা জানা নেই। পরে নথিপত্র ঘেঁটে জানান, এসআই কামরুজ্জামান ৩৪ ধারায় ওই নামের একজনকে আটক দেখিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে এমন আটকের নাটক করা হয়েছে কি-না খতিয়ে দেখা হবে।

এসআই কামরুজ্জামান সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আল্লাহর কসম টাকা নিয়ে এই আটক নাটক সাজাইনি।’ শাহজাদপুরের এক লোক নেশা করে রাতভর চিৎকার-চেঁচামেচি করল আর আশপাশের কেউ তা দেখল না- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমি ২২-২৩ দিন হলো এখানে এসেছি, কিছু চিনি না। আমার কোনো দোষ নেই।’

Pin It