ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় ভোর রাতে দুই ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন।
সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষ হয় বলে আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশের ওসি শ্যামলকান্তি দাশ জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন বলেন, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই দশ জনের মৃত্যু হয়। পরে বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ছয় জন মারা যায়।
আহত অর্ধশতাধিক যাত্রীকে কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মুন্না নামে ২০ বছর বয়সী এক তরুণকে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান বলেন, সিলেট থেকে ছেড়ে উদয়ন এক্সপ্রেস যাচ্ছিল চট্টগ্রামে। আর তূর্ণা নিশীথা চট্টগ্রাম থেকে যাচ্ছিল ঢাকায়।
“তূর্ণা নিশীথার চালকের অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি আমরা।”
মিয়া জাহান বলেন, মন্দবাগে দুই ট্রেনের ক্রসিং হচ্ছিল। সিগন্যাল পেয়ে উদয়ন মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে প্রবেশ করছিল।
“ট্রেনের নয়টি বগি লুপ লাইনে চলে যাওয়ার পর দশম বগিতে হিট করে তূর্ণা নিশীথা। ওই ট্রেনের লোকোমাস্টার সিগন্যাল অমান্য করায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি।”
সংঘর্ষের পর তূর্ণা নিশীথার একাধিক বগি উদয়নের কয়েকটি বগির ওপর উঠে যায়। এর মধ্যে দুটি বগি ভীষণভাবে দুমড়ে মুচড়ে যায়। সেখানে আরও মৃতদেহ থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকর্মীরা।
দুর্ঘটনার পরপরই রেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তিনটি ইউনিট এবং পুলিশ সদস্যরাও যোগ দেন।
দুর্ঘটনাস্থলের কাছে বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয়ে খোলা অস্থায়ী ক্যাম্পে দশ জনের লাশ রেখেছেন উদ্ধারকর্মীরা। এছাড়া কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে দুইজন এবং কুমিল্লা সদর হাসপাতালে একজনের মৃতদেহ রয়েছে।
দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার হবে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এছাড়া নিহতদের মরদেহ দাফনে সহযোগিতার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চাঁদপুর থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আবদুস সামাদ নামে একজন। তিনি জানান, তার বাবা-মা ছিলেন উদয়নের যাত্রী, সিলেট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে তার বাবার ফোন থেকে এক লোক কল করে দুর্ঘটনার খবর দেয়। সামাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে জানতে পারেন, তার বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক আহত যাত্রী বলেন, তাদের বগির অধিকাংশ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয় আর তিনি আসন থেকে ছিটকে পড়ে যান।
“পরে দেখি ট্রেন একবারে ছিন্নভিন্ন হইয়্যা গেছে। খালি চিৎকার আর চিৎকার মানুষের।”
হাসপাতালে ভর্তি আরেক কিশোর জানায়, মা, ভাই, দুই বোন আর নানীকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল তারা। দুর্ঘটনায় নানী আর এক বোন পায়ে আঘাত পেয়েছে। হট্টগোলের মধ্যে মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কুমিল্লা মেডিকেলে ভর্তি উদয়নের এক যাত্রী বলেন, তার বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে, সিলেট গিয়েছিলেন মাজার জিয়ারত করতে। ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়েছেন।
এদিকে দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিতু মরিয়মকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে তিনটি, রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলপথমন্ত্রী। রেলওয়ে সচিব মোহাম্মদ মোফাজ্জল করিম, জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, ৬০ বিজিবি সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনও ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন।
দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দুটি সরিয়ে লাইন আবার চলাচলের উপযোগী করতে লাকসাম ও আখাউড়া থেকে দুটি রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। ট্রেন চলাচল শুরু হতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে বলে রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দুর্ঘটনার পরপরই লাকসাম ও আখাউড়া থেকে দুটি রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। উদয়ন এক্সপ্রেস সামনের দিকের অক্ষত নয়টি বগি নিয়ে বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। আর মূল লাইন মেরামত শেষে বেলা পৌনে ১১টার দিকে তূর্ণা নিশীথা ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।