প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের অর্ধেক সময়েই ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ছয় মাস নয় দিনে (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি) এক হাজার ৬ কোটি ৫৩ লাখ ( ১০.০৬ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৯৪০ কোটি ৩৪ লাখ (৯.৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স এসেছিলো বাংলাদেশে। যা ছিল গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি।
আর ২০২০ সালের প্রথম মাস জানুয়ারি ৯ তারিখ পর্যন্ত এসেছে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ডলার। সবমিলিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ছয় মাস নয় দিনে ১০ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে বাংলাদেশ।
২০১৯ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে ১৬৮ কোটি ৭০ লাখ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে গত ডিসেম্বরে।
এখন পর্যন্ত এক মাসে সর্বোচ্চ ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে বাংলাদেশ; ২০১৯ সালের মে মাসে।
আর রেমিটেন্স প্রবাহের এই ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি আয়ে ধাক্কার পরও বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে।অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী। এই ‘বৈরি হাওয়ার’ মধ্যে একমাত্র রেমিটেন্সই আশার আলো ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ অন্য দেশেগুলোর মতো যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমালে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির এই গবেষক।
দুই শতাংশ হারে প্রণোদনার কারণেই রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, রেমিটেন্সে সুবাতাস বইছেই। প্রতি মাসেই বাড়ছে রেমিটেন্স।
বাংলাশে ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ‘সুখবর’ নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছর।
প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।অগাস্টে আসে ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।
অক্টোবর মাসে আসে ১৬৪ কোটি ডলার। নভেম্বর মাসে এসেছিল ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
রেমিটেন্স প্রবাহে সুখবর দিয়ে শেষ হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছর। ঔ বছরে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
রেমিটেন্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।প্রবাসীরা এখন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে যার নামে টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি ওই ১০০ টাকার সঙ্গে ২ টাকা যোগ করে ১০২ টাকা তুলতে পারছেন।
বাজেটে এ জন্য ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ আশা করছেন ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে রেমিটেন্সের পরিমাণ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
মন্ত্রী বলেন, গত অর্থবছরে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। প্রণোদনা দেওয়ায় এবার প্রবাহ খুবই ভালো।অর্থবছর শেষে রেমিটেন্স ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বর্তমানে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। জিডিপিতে তাদের পাঠানো অর্থের অবদান ১২ শতাংশের মত।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা এখন খারাপ। রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে আমদানি।
রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি। চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বিনিয়োগে খরা কাটছে না। ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড়। শেয়ারবাজারে তো মন্দা লেগেই আছে।
“সে কারণেই বলা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই এখন সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।তবে এই ধারা ধরে রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে
“এখানে একটা বিষয় আমি পরিস্কার করে বলতে চাই, প্রণোদনা বা ভর্তুকি দিয়ে রেমিটেন্সর ইতিবাচক ধারা ধরে রাখা যাবে না।আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা যাতে বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেটা শুধু দক্ষ শ্রমিক পাঠালেই সম্ভব হবে।অন্য কোনো পথে নয়।”
রিজার্ভ ৩১.৯০ বিলিয়ন ডলার
রেমিটেন্স বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নও (রিজার্ভ) সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।তবে গত সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু)আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ খানিকটা কমে এসেছে।
রোববার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে উঠিছিল। আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ৩১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
গত দুই মাসে তা বেড়ে ৩২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। গত সপ্তাহে আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার দেনা শোধের পর আবার কমে এসেছে।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।