মশার উৎপাত ফেরাচ্ছে ডেঙ্গুর ভয়

fogger-machine-Mosquito-killing-20082019-0004

শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে বেড়ে গেছে মশার উপদ্রব; নগরবাসীর মনে ফিরে আসছে ডেঙ্গুর ভয়।

এইডিস মশাবাহিত এ রোগ যে এখন সারাবছরের সমস্যা হয়ে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, সে কথা আগেই জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এবারের শীতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আগে ডিসেম্বর-জানুয়ারি সময়ে ডেঙ্গু হওয়ার ঘটনা ছিল কম। এবার জানুয়ারি মাসে নগরীতে এইডিস মশার উপস্থিতি যেমন বেশি পাওয়া গেছে, ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গতবারের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি রোগী।

ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই শীতের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে এবার। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশাও বাড়ছে। নগরবাসী বলছে, দিনের বেলা কোনোমতে পার হলেও সন্ধ্যার আগে থেকে শুরু হয় মশার উপদ্রব।

সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম চালানোর কথা বললেও নগরবাসীর অভিযোগ, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অপ্রতুল।

বাসাবোর সবুজবাগ এলাকার গৃহিনী সেলিনা আহমেদ বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ে এত লেখালেখি‌র পর গতবছর ওষুধ ছিটাইছিল। কিছুদিন মশা আসলেই কম ছিল। এরপর আর কোনো ওষুধ দিতে দেখি নাই। এখন আবার মশার উৎপাত বাড়ছে। সন্ধ্যার পর মশার উৎপাতে টেকা যায় না।”

একই অভিযোগ করেন ওই এলাকার মুদি দোকানি মিজানুর রহমান।

“আগে মশার ওষুধ ছিটাইছিল। এখন আর ছিটায় না। সপ্তাহ দুই মশার উৎপাত বাড়ছে খুব। সন্ধ্যার পর আমার দোকানে খাড়াইতে পারবেন না।”

উত্তরার সেক্টরগুলোতে মশার উপদ্রব কিছুটা কম হলেও ভোগান্তিতে আছেন পাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ। আজমপুর কাঁচাবাজারের বাসিন্দা হাসান আলীর ভাষায়, বিকেলে কোথাও দাঁড়ালে মাথার ওপর মশা ‘কিলবিল’ করে।

“হাঁটতে গেলে মশা আপনেরে জাইত্তা ধরব। ৫০ নম্বর ওয়ার্ড পড়ছে। এইখানে মশার ওষুধ ছিটাইতে দেখি নাই।”

মঙ্গলবার বিকালে বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে তার কথার মাজেজা বোঝা গেল। সড়কের পাশে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা শরীরে জেঁকে ধরল মশা। মাথার ওপরেও ভনভন শব্দ।

পাশেই পুরোনো পত্রিকা পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করছিলেন বাস কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা দুই তরুণ। শাহ আলম নামে একজন বললেন, মশার হাত থেকে বাঁচতেই এই ধোঁয়ার ব্যবস্থা।

“ভাই কী পরিমাণ মশা সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এইখানে জীবন্ত একজনরে এক ঘণ্টা রাখেন, দেখবেন মশা কামড়াইয়া তারে মাইরা ফেলব।”

জানুয়ারিতেও এইডিস মশা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ‘ডেঙ্গু সার্ভিলেন্স অ্যান্ড প্রেডিকশন প্রোজেক্ট’ এর আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশার উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা শাখা। সেজন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে মশার উপস্থিতি দেখা হচ্ছে। এ জরিপ চলবে আগামী দুই বছর।

এই জরিপ জানাচ্ছে, জানুয়ারি মাসেও রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশার উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, জানুয়ারিতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরীবাগ ও শাহবাগ এলাকায় মশার ব্রুটো ইনডেক্স ছিল সবচেয়ে বেশি- ২৬ দশমিক ৬৭। এছাড়া লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুরে ১০, গুলশান বনানীতে শূন্য, বাসাবো-খিলগাঁওয়ে ১৩ দশমিক ৩৩, শাঁখারীবাজার ও পাটুয়াটুলীতে ১৩ দশমিক ৩৩ ছিল।

ফেব্রুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গুলশান-বনানী এবং লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর এ দুটি অঞ্চলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, গুলশানে ব্রুটো ইনডেক্স বেড়ে ২০ হয়েছে। লালমাটিয়ায় কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭।

মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এইডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি’ বলা যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, জানুয়ারিতে মশার এতটা উপস্থিতি ভালো কথা নয়। জানুয়ারিতে ব্রুটো ইনডেক্স পাঁচের নিচে থাকার কথা।

“এ সময় এটা হলে সামনের পরিস্থিতি অনুমেয়। গত বছর জানুয়ারির চেয়ে এ বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বেশি। তার মানে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপও বেশি হতে পারে।”

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৮ জন। আর এ বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯৭ জন। আর ফেব্রুয়ারির প্রথম ১২ দিনে মোট ২২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এসেছে নানা রেকর্ড নিয়ে। ওই বছর সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআর ২৬৩টি মৃত্যুর তথ্য পাওয়ার পর তার মধ্যে ১৬৪ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুর কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করে।

মশার উৎপাত নিয়ে নাগরিকের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা.  মমিনুর রহমান মামুন বলেন, কিউলেক্স মশার অন্যতম প্রজননস্থল সরু নর্দমাগুলোতে মশার ওষুধ ছিটানো যায় না।

“সেখানে কীভাবে কাজ করব সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন সংস্থার জলাধারে কচুরিপানা আছে, যেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।”

আর এইডিস মশার উপস্থিতিও যে আশঙ্কা জাগানোর মত, তা স্বীকার করে মমিনুর রহমান মামুন বলেন, ব্রুটো ইনডেক্স ১০ এর বেশি হলেই তারা বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছেন।

“গুলশানের মত অভিজাত এলাকায় এইডিস মশা বেশি হচ্ছে। কারণ এসব এলাকার বাসায় প্রচুর পরিমাণ ফুলের টব ও অন্যান্য জিনিস রয়েছে, সেখানে এইডিস মশা জন্মাতে পারে। এছাড়া নির্মাণকাজও চলছে প্রচুর।

“গতবারও আমরা এসব এলাকায় এইডিসের উপস্থিতি বেশি দেখেছি। আমাদের কার্যক্রম চলছে, তবে পাশাপাশি বাসিন্দারাদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। তারা যদি সচেতন না হয় তাহলে এইডিসের প্রকোপ আমরা কমাতে পারব না।”

Pin It