বিএনপির মহাসচিব পদ নিয়ে আবারও গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তবে দলের সিনিয়র নেতারা বলছেন, এটা গুঞ্জনই। সত্য নয়। দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্যই এ ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
করোনার কারণে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। তাই এ গুঞ্জন নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের কেউই বিস্তারিত বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
জানা গেছে, গুঞ্জনের ডালপালা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। নতুন মহাসচিব হিসেবে কে আসতে পারেন, এমন নামও উচ্চারিত হচ্ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।
১৬ মার্চ ২০১১ সালে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তার মৃত্যুর কয়েকদিন পরে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সৌদি আরব সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে মির্জা ফখরুলকে দলের মহাসচিবের কাজ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়ে যান। দলের গঠনতন্ত্রে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলতে কোনো পদ না থাকলেও মির্জা ফখরুল প্রায় ৫ বছর সেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হয়েই ঝুলে ছিলেন বিএনপিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল হওয়ার ১১ দিন পর ৩০ মার্চ ২০১৬ পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের পদে আসেন দলটির সবচেয়ে নীতি আদর্শবাদী রাজনীতিক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যদিও বিএনপিতে মহাসচিব হওয়ার মতো এবং মির্জা ফখরুলের চেয়ে সিনিয়র কয়েক ডজন নেতা তখন ছিলেন। তারপরও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন ভদ্র-মার্জিত নেতাকে মহাসচিব করায় খালেদা জিয়া বিরোধী পক্ষের কাছ থেকেও ধন্যবাদ পেয়েছিলেন। সেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখনও হাল ধরে আছেন দলটির। এর মধ্যে কেটে গেছে আরও সাড়ে চার বছর। দলের কাউন্সিল করার সময়ও চলে গেছে দেড় বছর হলো।
২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে আছেন মির্জা ফখরুল। এর মধ্যে ২০১৮ সালে চেয়ারপারসন কারাগারে যান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগে থেকেই লন্ডনে নির্বাসনে। এমন অবস্থায় একমাত্র মহাসচিবই ছিলেন দলটির কাণ্ডারি। যদিও দশ বছরে নিজেও কয়েকবার তিনি জেলে গেছেন। বর্তমানে দলের চেয়ারপারসন কারামুক্ত হলেও রয়েছেন রাজনীতির অন্তরালে। শারীরিক অসুস্থতা, করোনা পরিস্থিতি ও সরকারের শর্ত, সবমিলিয়ে খালেদা জিয়ার শিগগিরই রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্কাইপির মাধ্যমে দল চালাচ্ছেন। আর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে মির্জা ফখরুলকে। এরই মধ্যে দলের ভেতরে ও বাইরে বহুবার মহাসচিব বদলের গুঞ্জন উঠেছে। কিন্তু সেসব গুঞ্জন বাস্তব হয়নি।
সূত্র জানায়, দল এবং দলের বাইরে এবারও সেরকমই গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিএনপিতে আসছেন নতুন মহাসচিব। যেহেতু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সেহেতু তার অনুসারী কেউ একজন এই দায়িত্ব পাবেন বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে সিনিয়র নেতারাও। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে মির্জা ফখরুল কী তারেক রহমানের অনুগত নন? তৃণমূল নেতারা বলছেন, অবশ্যই মির্জা ফখরুলও তারেক রহমানের অনুগত। না হলে এতদিন কিভাবে মহাসচিব পদে থাকলেন। তবে যেহেতু তার এই পদে আসার বয়স প্রায় দশ বছর সেহেতু অন্য কেউ এই পদে এলে সেটা বিচিত্র কিছু নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাসচিব পদে এবার তালিকায় নাম উঠেছে অন্তত তিনজন নেতার। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যার নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। অন্যদিকে অনেক সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে স্থায়ী কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নামও শোনা যাচ্ছে। তিনিও তারেক রহমানের খুব কাছের অনুসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তারেক বলয়ে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। সিরাজগঞ্জের রাজনীতিতে প্রভাশালী এই নেতা বর্তমানে দলের দুটি কমিটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির পর দলের জাতীয় করোনা পর্যবেক্ষণ কমিটির আহবায়ক, পরবর্তী সময়ে বন্যা পরিস্থিতিতে দলের গঠিত ত্রাণ কমিটিরও আহবায়ক করা হয়েছে তাকে।
অপরদিকে মহাসচিব পদটি পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ‘ফুলটাইম’ রাজনীতিবিদ সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এক-এগারো সরকারের সময় থেকে লাইম লাইটে আসা সাবেক এই ছাত্রদল নেতা অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী কখনই থেমে থাকেননি। চলছেন তো চলছেনই। মামলা, গ্রেফতার কিংবা করোনা, কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি রিজভীকে। দৈনিক মিডিয়ায় কথা বলে সংবাদ সম্মেলনের রেকর্ডটিও তার দখলে। দীর্ঘদিন ধরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদকের পদটি খালি থাকায় সেটিও সামলাচ্ছেন রুহুল কবির রিজভী। সেদিক থেকে তাকে যদি তারেক রহমান মহাসচিব ঘোষণা দেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির ৭ জন নেতা মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন- প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (১৯৭৮-৮৬), দ্বিতীয় মহাসচিব কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান (১৯৮৬-১৯৮৭), তৃতীয় মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান (১৯৮৭-১৯৮৮), চতুর্থ মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার (১৯৮৮-১৯৯৬), পঞ্চম মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (১৯৯৬-২০০৭), ষষ্ঠ মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন (২০০৭-২০১১), সপ্তম ও বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (২০১১- ২৯ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত এবং ৩০ মার্চ ২০১৬ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত)। দলটির অষ্টম মহাসচিবের দায়িত্ব কে পাবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “এ ধরনের সংবাদের কোনো ভিত্তি নেই, পুরোটাই রাবিশ। ”
অপরদিকে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “এটা উদ্ভট চিন্তা। দলের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার জন্য এসব খবর প্রচার করা হয়। এটা নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। ”
তিনি বলেন, “আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত আছে। তারপর যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়, তাহলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ”
ইকবাল হাসান বলেন, “আমি ত্রাণ কমিটির আহবায়ক, করোনা কমিটির আহবায়ক। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে কথা বলতে পারি। মহাসচিবের পদ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। ”