এক টেলিফোন আলাপেই বেরিয়ে এসেছে অনেক কিছু। গ্রামীণ জনপদে উন্নয়নের নামে লুটপাট, কাজ না করে বিল নেয়ার চেষ্টা, দুর্নীতি ঢাকতে উপজেলা প্রশাসনকে মোটা অংকের ঘুষ দেয়ার চেষ্টা এমনকি তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি আর দায়িত্ব পালনে গাফিলতি ঢাকতে কর্মকর্তাদের ঘুষ দাবি।
১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের এই টেলি সংলাপের অডিও ক্লিপটি এখন ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে; যার একপ্রান্তে ছিলেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেবী রানী হাওলাদার এবং অন্যপ্রান্তে একই ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য দিপালী হালদার।
সম্প্রতি দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অনাস্থা দিয়েছেন চেয়ারম্যান বেবী হালদারসহ কয়েকজন ইউপি সদস্য। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগে ওই অনাস্থা দেয়া হয়েছে বলে বলা হলেও ভেতর থেকে পাওয়া গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন খবর।
৪০ দিনের কর্মসূচির ঘুষের টাকা দিতে গড়িমসি করায় পদস্থ কর্মকর্তাদের ইঙ্গিতে নাকি দেয়া হয়েছে ওই অনাস্থা। উজিরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণতী বিশ্বাস অবশ্য এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মোবাইল ফোনালাপ যদি ফেব্রিকেটেড না হয় আর অভিযোগের সত্যতা মেলে, তাহলে যারা জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ উজিরপুর উপজেলা এবং বরিশালের জেলা প্রশাসনে তোলপাড় করা এই ফোনালাপের অডিও রেকর্ড বিষয়ে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণতী বিশ্বাসের সঙ্গে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফাঁস হওয়া কথোপকথনের খবর শুনেছি। তবে সেখানে মেম্বার-চেয়ারম্যান কী নিয়ে আলাপ করেছেন তা শুনিনি। অডিও রেকর্ডটি শুনে কোনো বিষয়ে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কথোপকথনে ইউএনওকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেই সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রণতী বিশ্বাস বলেন, উজিরপুর উপজেলায় এমন ঘটনা এটাই প্রথম। আমার বিরুদ্ধে পেছনে বসে কেউ কিছু বললে সেটি তো সত্য হয়ে যাবে না।
ইউএনও বলেন, ইউপি মেম্বার দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তার সঙ্গে দিপালী অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। সেই অভিযোগের তদন্ত চলছে।
উপজেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী গত বছরের শেষদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে।
শওকত আলী বলেন, ঠিক কবে অভিযোগটি দিয়েছিলাম মনে নেই। তবে দিপালী হালদার প্রতিবন্ধী ভাতার সার্টিফিকেট নিয়ে আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিলেন।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ-
ইউপি সদস্য দিপালী হালদার: মামি, আপনি শুধু শুধু মেম্বারদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে যে কমপ্লেইন দিলেন আর আপনিও সই দিলেন, এটা ভালো হইলো?
চেয়ারম্যান বেবী হালদার: মানে কী, তুমি আমারে দোষো কেনো, খালি খালি কমপ্লেইন দিছি মেম্বারদের দিয়া, এডা কেমন কথা?
দিপালী: এহন শোনেন, আপনে যে টাকা চাইছেন আমার কাছে, আমি দিছি না আপনারে? ৭০ হাজার টাকা দিছি, আগের কর্মসূচির দিছি ৫০ হাজার টাকা। তাইলে আমি কি আপনারে কম দিছি টাকা বলেন? আমি কর্মসূচির টাকা দিছি ৭০ হাজার, আপনি সেটা বলবেন না ইউএনওকে?
বেবী: ৭০ হাজার দেও আর তুমি ৯০ হাজার দেও, সেটা কোনো বিষয় না। তোমার আসবে কত? হিসাব থাকতে হবে, কত টাকায় কত আসবে। ৭০ হাজার আর ৯০ হাজারের কোনো প্রশ্ন না এখানে।
দিপালী: না…আপনি বলছেন তোমার উপজেলা চাইছে ৪০ হাজার, আর…দিছি এত, এটা বলে বলছেন ১ লাখ টাকা। এহন আমি আপনারে ৭০ হাজার টাকা দিছি, আগের বিলে দিছি ৫০ হাজার টাকা।
বেবী: কিসের তোমার ১ লাখ টাকা? তোমার পার্সেন্টিজ কত আসবে সেটা জানে সচিব, তা তো আমিও জানি না এখনও। আর উপজেলা দিয়া ধরছে তোমার এবং চেয়ারম্যানের দুইডা প্রজেক্টে তাদের বেশি অভিযোগ, আর সব প্রজেক্ট তো দেখে নাই সেদিন। তারা ৩-৪টা প্রজেক্ট দেখছে, তার মধ্যে এই ২টা প্রজেক্টে বেশি অভিযোগ তাদের। পিআইও (অয়ন সাহা) লিখে দিছে- চেয়ারম্যানের প্রজেক্টে ১ লাখ ১০ হাজার, আর তোমার প্রজেক্টে দিছে ৯০ হাজার। এই দুইটা প্রজেক্ট দিয়া আমরা এইডা…দাবি করি। আর অন্য প্রজেক্ট বাদ-ই দিলাম, এইডা আমরা দাবি করি, এই ২ লাখ টাকা। তো অন্যান্য মেম্বাররা, তারা যে… ১০-১৫ হাজার করে দিছে, তারাই তো ভালা। এখন আমি তো…এরপরে সবাই মিলে আমারে ধরছে ৭০ হাজার, তোমারে ধরছে কত, ৫০ না জানি কত হাজার।
দিপালী: আমারে টাকা ধরছে কে, আপনি?
বেবী: সবাই মিলে, সব মেম্বাররা…১০-১৫ হাজার টাকা করে, যার যার কাজের মানের ওপর। আমারে একারে ধরছে ৭০ হাজার, আমি সেই ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দিছি, একেবারে নগদ দিছি… সচিবের কাছে ৭০ হাজার টাকা জমা। আর উপজেলার টাকার সাথে পার্সেন্টিজের টাকার কী যোগাযোগ, তুমি আগে পার্সেন্টিজ বাবদ ৫০ হাজার টাকা দিয়া দিছো। আর শেষে তুমি ২০ হাজার টাকা দিছো, এখন তোমার কাছে পার্সেন্টিজের হিসাবে আরও পায়।
দিপালী: আমি একবার ৭০ হাজার, পরে ৫০ হাজার টাকা দিছি, ওই কাজে আমি মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিছি, আর কত দিবো? এজন্যই তো রাগ হয়ে বলছি, আমি আর টাকা দিতে পারব না।
বেবী: আমি চেয়ারম্যান হইয়া ৭০ হাজার টাকা দিতে পারছি, আমার স্বামী (নিহত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালাদার নান্টু) এতো টাকা ঋণ-দেনা রেখে গেছে, ব্যাংকে…বাড়ি-ঘর সব। আমি সেগুলো দিতে পারছি, আমি চেয়ারম্যান হইয়া। আর তোমরা মেম্বার হইয়া দিতে পারবা না, তোমরা উপজেলায় গিয়া বুঝবা, এইখানে বুঝবা, ওইখানে বুঝবা। বেশ বোঝো, সমস্যা কী?
দিপালী: আমাদের কাজ ভালো না হলে তারা (উপজেলা প্রশাসন) বিল দিবে না, কিন্তু ইউএনও, পিআইও আমাদের কাছে এতো টাকা চায় কেন? এগুলো আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন না।
বেবী: বলতে পারি না…আবার, বলছি না। সব ইউনিয়ন থেকেই নিছে, যে যে ইউনিয়নের কাজের মান ভালো না, সবাই-ই দিছে, কম আর বেশি। এখন… জল্লা ইউনিয়নের কাজ যথেষ্ঠ খারাপ কইছে। জল্লা থেকে ২ লাখ টাকার কম তারা (উপজেলা প্রশাসন) নিবেই না, আমি দেড় লাখ টাকা নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে ঘুরতেছি। তারা (উপজেলা প্রশাসন) কোনো টাকাই ধরে না, ২ লাখ টাকার এক টাকাও কম নিবে না। ইউএনওর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত টাইম নিছিলাম যে এর মধ্যে টাকা দিয়ে দিব। শেষে আমারে ইউএনও পর্যন্ত ধরছে সেই টাকার জন্য। আগে তো…পিআইওর সাথে সচিবের সাথে কথা হতো। আমার সাথে বেশি কিছু বলে নাই। এখন তো ইউএনও সরাসরি সেদিন আমারে ধরছে যে আপনি সেই টাকা কবে দিবেন? আপনি তারিখ দেন কবে দিবেন। আমি তারিখ দিয়ে আসছি, গত সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু সেই তারিখ তো শেষ, এখন এই সপ্তাহও যায়। তারা (উপজেলা প্রশাসন) এক টাকাও কম নেবে না।
কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার বলেন, আমি ওই ধরনের কোনো কথা বলিনি। কেউ হয়তো আমার কণ্ঠ নকল করে অডিও ছড়িয়ে দিয়েছে।
পরক্ষণেই এই চেয়ারম্যান বলেন, ইউপি মেম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। তা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বেকায়দায় আছি। কোনো কথা বলতে পারছি না।
ইউপি সদস্য দিপালী হালদার স্বীকার করেন কথোপকথনের কণ্ঠ তার কিন্তু যা বলেছেন সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহা বলেন, অনিয়মের অভিযোগে বেশ কয়েকটি কাজের টাকা আমরা আটকে দিয়েছি।
ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, যা বলছে তা তাদের বিষয়। কেউ বললেই তো সত্য হয় না। আর সরকারি কর্মকর্তাদের না ব্যবহার করে অন্য কেউ টাকা তুললে তাতে আমার কী?
অয়ন সাহা দাবি করেন, তিনি কোনো ঘুষ গ্রহণ করেননি।
প্রসঙ্গত, উজিরপুর উপজেলার ৩নং জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে যে, ওই ইউনিয়নের সব প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে কাজ না করে টাকা নিয়ে গেছেন জনপ্রতিনিধিরা। ঘুষের সেই টাকার ভাগাভাগি নিয়েই এ কথোপকথনটি ফাঁস হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।