ভারতের ওড়িশা রাজ্যের একটি জেলার একজন সাধারণ কাউন্সিলর হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন।
সরকারি দফতরে করণিক, স্কুল শিক্ষিকা, কাউন্সিলর, বিধায়ক, মন্ত্রী, রাজ্যপাল থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন ‘রাইসিনা হিল’ এর পথযাত্রায় শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ যশবন্ত সিনহাকে পরাজিত করে নিজের কর্মজীবনের একটা বৃত্ত পূরণ করলেন দ্রৌপদী।
সাঁওতাল পরিবারে জন্ম নেওয়া দ্রৌপদীই ভারতের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি। দেশটির রাষ্ট্রপতি পদে আসিন হওয়া দ্বিতীয় নারী তিনি।
ওড়িশার ময়ূরভাঞ্জ জেলার ছোট্ট গ্রাম বাইদাপোসিতে ১৯৫৮ সালের ২০ জুন জন্মগ্রহণ করেন দ্রৌপদী। বর্তমানে তার বয়স ৬৪ বছর। বয়স দিয়েও তিনি দুইটি নতুন রেকর্ড গড়েছেন।
তিনিই এখন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। ভারতের স্বাধীনতার পর জন্ম নেওয়া কেউ এই প্রথম দেশটির সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন।
ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২৪ জুলাই। এর পরেই দ্রৌপদী ভারতের পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবেন।
ভারতের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দিল্লির অস্থায়ী বাসভবনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে দ্রৌপদী মুর্মুর।ছবি: রয়টার্সভারতের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দিল্লির অস্থায়ী বাসভবনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে দ্রৌপদী মুর্মুর।ছবি: রয়টার্সএবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয় গত সোমবার। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হওয়ায় তিনি আগে থেকেই এগিয়ে ছিলেন। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় ভোট গণনা শুরু হয়। বিকাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল সহজেই জিতে যাচ্ছেন দ্রৌপদী।
খানিকটা ‘লো-প্রফাইলের’ এই রাজনীতিবিদ আধ্যাত্মিকতায় প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাসী এবং তিনি নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে ‘ব্রহ্মা কুমারিস’ ধ্যান কৌশল অনুশীলন করেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে স্বামী, দুই ছেলে, মা এবং ভাইকে হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া দ্রৌপদী জীবনে ফিরতে ওই ধ্যান অনুশীলন শুরু করেন বলে জানায় এনডিটিভি।
এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দূরদর্শনে এক সাক্ষাৎকারে দ্রৌপদী বলেছিলেন, ‘‘আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং গভীর হতাশায় ভুগছিলাম। ২০০৯ সালে ছেলের মৃত্যুর পর থেকে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। ‘ব্রহ্মা কুমারিস’ ভ্রমণের পর আমি বুঝতে পারি আমাকে এগিয়ে যেতে হবে এবং আমার বাকি দুই ছেলে এবং মেয়ের জন্য বেঁচে থাকতে হবে।”
গত ২১ জুন বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ থেকে দ্রৌপদীকে তাদের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। এতবড় সুযোগ পাওয়ার পরও তিনি জনসম্মুখে কোনো বিবৃতি দেননি।
তবে তিনি নির্বাচনী প্রচারের জন্য পুরো দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং প্রতিটি রাজ্যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন বলে জানায় এনডিটিভি।
গ্রাম প্রধানের মেয়ে দ্রৌপদী ওড়িশার রাজধানী ভূবনেশ্বরের রামাদেবী উইমেন্স কলেজে লেখাপড়া করেছেন।
রাজ্য সরকারের একজন কেরানি হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যের কৃষি ও জ্বালানি অধিদপ্তরে একজন জুনিয়র এসিস্টেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন।
ভারতের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দিল্লিতে দ্রৌপদী মুর্মুর অস্থায়ী বাসভবনে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।ছবি: রয়টার্সভারতের প্রথম আদিবাসী নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দিল্লিতে দ্রৌপদী মুর্মুর অস্থায়ী বাসভবনে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।ছবি: রয়টার্স১৯৯৪-৯৭ সাল পর্যন্ত রাইরংপুরে শ্রী অরবিন্দ ইনটেগরাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। দ্রৌপদীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। সেবার তিনি রাইরংপুর জেলার স্থানীয় নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
বিজেপি’র হয়ে রাইরংপুর আসন থেকে তিনি ২০০০ ও ২০০৯ সালে দুইবার বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০০-২০০৪ সালে তিনি রাজ্যের জোট সরকারের একজন মন্ত্রীও ছিলেন।
প্রথমে বাণিজ্য ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করলেও পরে তিনি মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় সামলান। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্য বিজেপি’র ‘পিছিয়ে পড়া আদিবাসী’ শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রথম নারী রাজ্যপাল (গভর্নর) হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ২০১৫ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। দ্রৌপদী ওড়িশার প্রথম আদিবাসী নেত্রী যিনি রাজ্যপালের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত টানা ছয় বছর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। বিবিসি জানায়, দ্রৌপদী মুর্মু বেশ সুনামের সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কার্যালয়ের দরজা সব সময় সব শ্রেণীর মানুষের জন্য খোলা থাকত।
রাজ্যপালের দায়িত্ব ছাড়ার পর দ্রৌপদী ধ্যান করে সময় কাটাতে থাকেন। সঙ্গে রাইরংপুরে নানা সমাজকল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন।
ভারতের এনডিএ সরকার যে তাকে তাদের প্রেসিডন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে সে খবর তিনি টেলিভিশনের সংবাদ থেকে জানতে পেরেছেন বলে বিবিসি-কে সেসময় বলেছিলেন। যা তাকে একইসঙ্গে ‘বিস্মিত’ এবং ‘আনন্দিত’ করেছে।
পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘ময়ূরভাঞ্জ জেলার মত একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন আদিবাসী নারী হিসেবে আমি দেশের সর্বোচ্চ পদের জন্য একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারব এমনটা আগে ভাবিনি।”
যেটা তিনি ভাবতে পারেননি সেটাই আজ বাস্তব। একজন সাধারণ কাউন্সিলর থেকে তিনিই আজ ভারতের পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি।