পাকিস্তানের ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহেরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বঞ্চিত করা হয়েছে; এ অভিযোগের অসন্তোষ জিইয়ে রেখে নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলো। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন), পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মাঝে নতুন সরকারে কাজ করার মতো চলনসই একটি জুটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পিপিপি নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো বলছেন, যেহেতু কারোরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই; তাই এই ঝুলন্ত সংসদের অর্থ হচ্ছে; আবার একটি নতুন নির্বাচন আয়োজন। কিন্তু পাকিস্তানের এই ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায় নতুন নির্বাচনের পথে হাঁটার জো নেই। তাই পিপিপি সরকার গঠনে পিএমএলএনকে সহযোগিতা করবে; শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী হতে সমর্থন দেবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় কোনো সদস্য পদ নেবে না। তবে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও চারটি প্রদেশে গভর্নরের সাংবিধানিক পদগুলো তারা নিচ্ছে।
পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়ালের এই যে ভঙ্গুর রাষ্ট্র মেরামতের দায়িত্ব না নেওয়া; পিটিআই-এর চলমান আন্দোলনে পর্যুদস্ত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে দূরে থাকা; এই পরিস্থিতির কৌতুক অনুবাদ এমনটাই শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে, পিপলস পার্টি সমাজের চাপাচাপিতে পিএমএলএনকে বিয়ে করতে রাজি কিন্তু সংসারের কোনো দায়িত্ব নেবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম আলোচনাও রয়েছে যে, একদা প্লেবয় খ্যাত ইমরান কারাগারে থাকার সুযোগে তরুণ বিলাওয়াল যেন পলিটিক্যাল প্লেবয় হয়ে উঠছেন। এই যে শরিফ পরিবারের সেনা সমর্থিত পুতুল রাজনীতিক বলে যে দুর্নাম; তার ভাগিদার না হয়ে; বিলাওয়াল ঠিকই পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখছেন; এর চেয়ে কৌশলী রাজনৈতিক খেলা আর কিইবা হতে পারে। আবার তিনি নির্বাচনের আগে ইমরান খানের প্রতি সমানুভূতি প্রকাশেও কৃপণ হননি।
ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিলাওয়ালের বাবা আসিফ আলী জারদারি ও শাহবাজ শরিফ একসঙ্গে হয়েছিলেন। পিপিপি, পিএমএলএন, এমকিউএম, মুসলিম লীগ কিংস গ্রুপ, বেলুচিস্তানের একটি রাজনৈতিক দল, পিটিআই থেকে হর্স ট্রেডিং করে কিনে আনা সংসদ-সদস্যদের দিয়ে তৈরি ছোট একটি দল আর জামায়াতে উলেমা ইসলামির মওলানা ফজলুর রহমান; এইরকম রুপি-আনা-পাই দিয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)।
রাজনীতির কাশিমবাজার কুটিরে এই দলগুলোর নেতারা আবার একসঙ্গে হয়েছেন ইমরান ঠেকাতে। এর পরিবর্তে জারদারি পেতে যাচ্ছেন কিছুকাল পরে খালি হওয়া প্রেসিডেন্ট পদ, অন্য দলগুলো শাহবাজের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় কিছু পদ পাবে।
প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বড় হবে এই মন্ত্রিসভা। দারিদ্র্যে বিশীর্ণ পাকিস্তানে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশাল গাড়িতে জনগণের জ্বালানি পুড়িয়ে পতাকা উড়িয়ে ঘুরবেন তারা; থাকবেন সরকারি বাসভবনে। পিডিএম টু পয়েন্ট ও’র শ্বেতহাতি প্রতিপালনই হচ্ছে সমসাময়িক পাকিস্তান রাজনীতির ট্র্যাজেডি। এইখানে সাবেক ইমরান খানের সরকার ছিল মিতব্যয়ী। ইমরান খান সরকারি ব্যয় সংকুচিত করেছিলেন, এক কাপ চায়ের বেশি সব বরাদ্দ বাতিল করেছিলেন সরকারি বৈঠকে।
ঘুস-দুর্নীতি বন্ধ করতে হোয়াটসঅ্যাপে ইমরান যেন সরকার চালাতেন। কোনো দপ্তরে ঘুসের অভিযোগ এলেই ইমরানের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পৌঁছে যেত সেই দপ্তর প্রধানের কাছে। ৭৫ বছরের দুর্নীতির জিনগত আশ্লেষ এত অল্প সময়ে সরানো অসম্ভব। তবু ইমরানের সততার কড়াকড়িতে সামরিক ও বেসামরিক কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার প্রাণওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। ফলে রাষ্ট্রের নানা প্রান্তের দুর্নীতি রাক্ষসের আক্রোশের স্বীকার হন ইমরান। ইমরান সরকারের একমাত্র সমস্যা ছিল তার মন্ত্রিসভার রাষ্ট্রপরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাব। আর যখনই ইমরানের মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতার উত্থান ঘটে; তখন ইতিহাসে দেখা অন্যান্য দেশের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদ বেড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউথিয়া বলে পরিচিত ইমরানের তরুণ সমর্থকরা ভিন্নমত দেখলেই বলতেন, ‘ইমরানের নেতৃত্ব যদি পছন্দ না হয়; তাহলে আমেরিকা চলে যান।’ যে ছেলেরা চাকরিতে তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তারা উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে মাথায় পতাকা বেঁধে পথে ঘুরতে শুরু করলেন। দেশপ্রেম প্রদর্শনের এ বাতিক যুবসমাজে তৈরি হওয়া মানেই খাঁটি দেশপ্রেম ফিকে হয়ে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দেওয়া গ্যাং তৈরি হওয়া; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভূমি বাস্তবতায়। সে কারণে পাকিস্তানের জন্য এই মুহূর্তে পিটিআই বিরোধী দলে থাকা স্বাস্থ্যপ্রদ। রাজনৈতিক জীবনের খরখরে বাস্তবতা বুঝতে শিখলে তখন গাজোয়ারি উগ্রজাতীয়তাবাদের অহম কমে আসে। জনগণকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসার বোধ তৈরি হয়।
ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পর পিডিএম জোটের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শাহবাজ শরিফ দায়িত্ব পালন করেছেন; কেয়ারটেকার সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে পর্যন্ত। কেয়ারটেকার সরকার কিছু ক্ষেত্রে শাহবাজ সরকারের চেয়ে ভালো কাজ করেছে এমন অভিমত আছে। ফলে নতুন করে এই পিডিএম টু পয়েন্ট ওর নির্বাচিত শাহবাজের প্রতি জন আস্থা তেমন নেই বললেই চলে। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী মনোনীত শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেশ উন্নয়ন সাফল্য অর্জন করেছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মেট্রোরেল-এক্সপ্রেস হাইওয়েসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, নারীশিক্ষায় উপবৃত্তি প্রচলন, বিদ্যালয়ের বাইরে যেন কোনো শিশু না থাকে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া, কৃষক যাতে ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রায় সে লক্ষ্যে সুষম বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা; এরকম সাফল্যের কারণে পাঞ্জাব পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে এগিয়ে গেছে নানাভাবে। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো বিবাদে যান না আবার পুরোপুরি সেনাবশ্যতা স্বীকার করেন না; ফলে তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জনগণ উপকৃত হয়; এমন সুনাম আছে। উন্নয়ন সহযোগী চীন শাহবাজকে পছন্দ করে; কারণ তিনি চীনের উন্নয়ন কাজের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন।
পিএমএলএন নেতা নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুসম্পর্ক এত গভীর যে একবার মোদি হঠাৎ বিমান ঘুরিয়ে লাহোরে নেমে নওয়াজ গৃহে দাওয়াত খেয়ে আবার উড়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক যেহেতু পাকিস্তান-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধিকে উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জনের চাবিকাঠি বলে এই সেদিনও মন্তব্য করেছে; কাজেই পাকিস্তানের নতুন সরকারটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে উন্নয়ন ঘটবে তা আঁচ পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ইমরানের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিকে ভালো চোখে দেখেনি; তাই শরিফ সরকারে তাদের সমর্থন থাকবে বলেই মনে হয়। ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে একটি আসনে হেরে ও একটি আসনে বিতর্কিতভাবে কোনোমতে জিতে নওয়াজ শরিফের চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না হলেও তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন যেন কমেডি জোগান দিতে। কাজের চেয়ে কথায় পারদর্শী তিনি। সোশ্যাল মিডিয়া ও মিডিয়ায় নিয়মিত তিনি ঝগড়া করেছেন, ইমরান খানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারতন্ত্রের উত্তরাধিকার পাওয়া নেতৃত্বের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ যে অপরিমিত ও দায়িত্বহীন ব্যবহার পেয়ে আসছে; মরিয়ম যেন তারই ধারাবাহিকতা।
পাকিস্তানের রাজনীতি যদি ড্রামা সিরিয়াল হয়; তাহলে এর সবচেয়ে কালারফুল অ্যান্টি হিরোইন হচ্ছেন এই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত।
সম্প্রতি অন্য একটি মামলার শুনানির সময় পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কাজি ফয়েজ ঈসা সেনা-প্রশাসনকে সরাসরি বলেছেন, সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ফেলে রেখে তারা যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় নাক গলিয়ে বেড়ায়; সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব তৈরির প্রয়োজনে এসব অসাংবিধানিক কাজের অবসান ঘটাতে হবে। প্রধান বিচারপতির এই তিরস্কারে আঁচ পাওয়া যায়, সেনাপ্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের একটা আইনগত ভিত্তিও তৈরি হতে যাচ্ছে।
ইমরানের সমর্থক রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ ভোটার যাদের অভিযোগ, ভোটের ফলাফল চুরি করেছে এই সেনাপ্রশাসন তাদের সামনের দিনগুলো শাহবাজ সরকারের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমার যে নয়; তা পাকিস্তানে চলমান জনঅসন্তোষ ও প্রধান বিচারপতির প্রতিক্রিয়া থেকে ধারণা করা যায়।