পাইপ বসিয়েই ৫৭৩ কোটি টাকা হরিলুট

Bd-Pratidin-28-08-19-F-01

রাজধানীর মিরপুরে পানি সরবরাহে নেওয়া ওয়াসার ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে গভীর নলকূপসহ পাম্প বসানোর জায়গায় শুধু পাইপ বসিয়ে কাজ শেষ করেছেন ঠিকাদার। ৪৬টি গভীর নলকূপ বসানোর কথা থাকলেও ৫টিতে পানি ওঠানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিই বসানো হয়নি। এ ছাড়া ৩টিতে শুধু নলকূপের পাইপ বসিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করে বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে ধাপে ধাপে হরিলুট চললেও এখনো অধিগ্রহণ করা জমির অর্থ পরিশোধ করা হয়নি ক্ষতিগ্রস্তদের। ওয়াসার এ প্রকল্পের মূল ঠিকাদার কোরিয়ান কোম্পানি হুন্দাই রোটেম। তবে তাদের নিয়োগকৃত স্থানীয় ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে অ্যারিডড গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আজিজুল আকিল ডেভিড বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাভারের ভাকুর্তা ও কেরানীগঞ্জে প্রকল্পের কাজ শেষে তা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রকল্প যেহেতু শেষ বিল ঠিকাদারকে পরিশোধের কথা। তবে টাকার লেনদেন ওয়াসার সঙ্গে হুন্দাই কোম্পানির হয়েছে।’ প্রকল্প হস্তান্তর হলেও ৫টি পাম্প বন্ধ এবং ৩টিতে শুধু পাইপ বসিয়ে রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘ওই প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য এখনো স্থানীয়দের পরিশোধ করা হয়নি। এজন্য আমরা শেষ করতে পারিনি। তাদের বুঝিয়ে শুধু পাইপটুকু বসাতে পেরেছি। অন্য কয়েকটি গভীর নলকূপের ছোটখাটো কিছু কাজ বাকি আছে।’

সার্বিক বিষয়ে ওয়াসার এ প্রকল্পের পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সাতবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ প্রকল্পের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের কাজ শেষের প্রতিবেদন এখনো জমা হয়নি। তাই কিছু কাজ হয়তো বাকি থাকতে পারে। তবে স্থানীয়দের অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য পরিশোধের বিষয়টি আমার জানা নেই। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি কিংবা ঠিকাদারদের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই।’ তিনি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

‘ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় পানির চাহিদা পূরণকল্পে মিরপুরের ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা হ্রাসকরণ প্রকল্প’-এর জন্য সাভারের ভাকুর্তা, তেঁতুলঝোড়া ও কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নে জায়গা নির্বাচন করা হয়। ঢাকার পানির স্তর নিচে নামা ঠেকাতে ভূগর্ভস্থ পানি তোলার জন্য গভীর নলকূপ বসাতে বেছে নেওয়া হয় এ ইউনিয়নগুলোকে। কিন্তু এ প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বছরের ৭ জুলাই এ প্রকল্প অনুসন্ধান শেষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে দুদক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয় না মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে। যেমন ‘ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকার পানির চাহিদা পূরণকল্পে মিরপুরের ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা হ্রাসকরণ প্রকল্প’টি ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর অনুমোদিত হয়। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী সরকারি তহবিল (জিওবি) থেকে ১৪২ কোটি টাকা, ওয়াসা ১০ কোটি টাকা আর এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া ও দ্য গভর্নমেন্ট এজেন্সি ফর দি ইডিসিএফ প্রকল্পে সাহায্য করেছে ৩৬৯ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে মোট ৫২১ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ৫৭৩ কোটি টাকায় বাড়ানো হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে অযৌক্তিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ৫২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের কাজের অঙ্গসমূহের মধ্যে ৪৬টি উৎপাদনযোগ্য কূপ, ২টি আয়রন অপসারণ প্লান্ট, ১টি ভূউপরিস্থ জলাধার, ৭.৮১ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, ৪৮ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার পানি সরবরাহ লাইন (২০০-১২০০ মিমি ব্যাস) নির্মাণকাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হলেও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাস্তব কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৬ শতাংশ। এ কাজে ঠিকাদারকে ৩১৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা সংশোধিত ডিপিপি মূল্যের ৫৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের পার্থক্য অনেক। সরেজমিন সাভারের ভাকুর্তা, তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নে দেখা যায়, তেঁতুলঝোড়ায় বসানো ৫টি গভীর নলকূপের সবই বন্ধ। ঝাউচর বাজার, উত্তর মেইটকা, শ্যামপুর, দক্ষিণ শ্যামপুর ও মুসুরিখোলায় বসানো গভীর নলকূপগুলো সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রধান ফটক বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। মধ্য শ্যামপুর এলাকার মুদি দোকানি রঞ্জু আলী বলেন, এ পাম্প তৈরি হওয়ার পর থেকে কোনো দিন চালু হয়নি। এই গভীর নলকূপগুলো রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কেন্দ্র থেকে সিগন্যালের মাধ্যমে বার্তা দিয়ে অটোমেটিকভাবে চালু ও বন্ধ করা যাবে। অথচ মুসুরিখোলায় স্থাপিত পাম্পে স্কাডা অর্থা সিগন্যাল প্রেরণে ব্যবহৃত যন্ত্রই বসানো হয়নি।

ভাকুর্তার কলাবাগান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একপাশে ৩ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে আর নলকূপের পাইপ বসিয়ে কাজ ফেলে রাখা হয়েছে। চুনারচর এলাকায় দেখা যায়, একপাশে গভীর নলকূপের পাইপ বসানো হয়েছে। সীমানাপ্রাচীর দিয়ে অসম্পূর্ণ ভবন ফেলে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় আগাছায় ভরে গেছে পাম্পের নির্ধারিত জায়গাটুকু। একই পরিস্থিতি কাইশার চরেও। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও স্থানীয়দের এখনো পরিশোধ করা হয়নি অধিগ্রহণ করা জমির দাম। তাই এলাকাবাসীর মধ্যে রয়েছে তীব্র ক্ষোভ। এদিকে যে কটা গভীর নলকূপ চালু হয়েছে তাতেই খাঁখাঁ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এলাকাজুড়ে। ভাকুর্তার কোনো বাড়ির টিউবওয়েল দিয়ে আর পানি উঠছে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় খেতে সেচ দিতে পারছে না কৃষক। এ এলাকার ইরি ধান চাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষক আলমাস মিয়া বলেন, ‘ওয়াসা আমাদের ধ্বংস করে দিল। প্রতিটি খেত পতিত পড়ে থাকে শীত-গ্রীষ্মের মৌসুমে। বাড়িতে খাওয়ার পানি নাই। ঢাকায় পানি দিতে গিয়ে আমাদের তৃষ্ণায় মারছে।’ ক্ষোভে গত মে মাসে ওয়াসার পাম্প ভাঙচুর করেছে এলাকাবাসী। এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে ওয়াসা। ওয়াসার প্রস্তাবিত প্রকল্পে পানির লাইন নেওয়ার জন্য রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ সংস্কার বাবদ রাখা হয়েছিল ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু রাস্তার সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খোঁড়ার কারণে খানাখন্দে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এ এলাকার রাস্তা।

Pin It