পুরনো শ্রমবাজার সংকুচিত মিলছে না নতুন বাজার

Untitled-9-5c9a817fe7383

মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান কমছে বাংলাদেশি কর্মীদের। ২০১৭ সালের তুলনায় গত বছর এসব দেশে কর্মসংস্থান প্রায় অর্ধেক কমেছে। চলতি বছরের প্রথম দু’মাসেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও বন্ধ হয়ে আছে। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগের কথা বললেও নতুন কোনো শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শ্রম কূটনীতি জোরদার করার কথা বলছেন পর্যবেক্ষকরা।

ইউরোপ, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গত দু’বছর ধরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা বলছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু জাপানে হাতে গোনা কর্মী পাঠানো ছাড়া অন্য কোথাও শ্রমবাজার খোলেনি বাংলাদেশিদের জন্য।

জনশক্তি খাত-সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের উদ্যোগের ঘাটতিতেই নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে না। কয়েক যুগের পুরনো নীতিতে চলছে এ খাত। রফতানিকারকরা যেসব দেশের চাহিদাপত্র আনতে পারেন, শুধু সেখানেই বাংলাদেশ কর্মী পাঠাতে পারে। বাংলাদেশি কর্মীদের প্রায় ৯৫ শতাংশ এমন সব দেশে যান যেগুলোতে শ্রম আইন দুর্বল ও বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন সাধারণ ঘটনা। দক্ষতার ঘাটতি থাকায় পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে বাংলাদেশ কর্মী পাঠাতে পারে না।

অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষার সুনাম রয়েছে; যা মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে নেই। এসব অঞ্চলের দেশই অধিকাংশ বাংলাদেশি কর্মীর গন্তব্য। ফলে নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হতে হয় তাদের। উন্নত দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্য যেসব কাজ বা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অথচ দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে না পারলে উন্নত দেশের বাজার বাংলাদেশিদের জন্য খুলবে না।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিদেশে কাজ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন সাত লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ বাংলাদেশি কর্মী। ২০১৭ সালে বিদেশ গেছেন ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন। আগের বছরের তুলনায় গত বছর বিদেশে কর্মসংস্থান কম হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০১৯ সালের প্রথম দু’মাসে বিদেশ গেছেন এক লাখ নয় হাজার ৬০৭ জন। তাদের অর্ধেক ৫৪ হাজার ৮০৭ জন গেছেন সৌদি আরবে। অন্যদের গন্তব্যও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান, কাতার ও জর্ডান।

চলতি বছরের প্রথম দু’মাসে জাপান গেছেন ২৬ কর্মী। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য ও ইতালিতে কর্মসংস্থান হয়নি একজন বাংলাদেশিরও। একই চিত্র ছিল ২০১৮ সালে। গত বছর বাংলাদেশি কর্মীদের প্রায় ৯০ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান ও ইরাকে।

জ্বালানি তেলের দরপতনে মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। গত বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানিতে ভাটা শুরু হয়। ২০১৭ সালে পাঁচ লাখ ৫১ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে সৌদি আরব গিয়েছেন দুই লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ জন। সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি অর্ধেকের বেশি কমে গেছে।

গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই ২০১৭ সালের তুলনায় জনশক্তি রফতানি কমেছে। আরব আমিরাত ও বাহরাইনে কর্মী পাঠানো বন্ধের পথে। আগের বছরের তুলনায় কমলেও কাতার ও ওমানের শ্রমবাজার অন্যান্য দেশের তুলনায় স্থিতিশীল ছিল ২০১৮ সালে। ২০১৭ সালে ওমান যান ৮৯ হাজার ৭২ কর্মী। গত বছর গেছেন ৭২ হাজার ৫০৪ জন। ২০১৭ সালে কাতার যান ৮২ হাজার ১২ জন। ২০১৮ সালে গেছেন ৭৬ হাজার ৫৬০ জন।

গত বছর জনশক্তি রফতানি বেড়েছিল একমাত্র মালয়েশিয়ায়। ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ৯৯ হাজার ৭৮৭ কর্মী। ২০১৮ সালে গেছেন এক লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন। গত বছরের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে এসব কর্মী কাজ পেয়েছেন মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির কারণে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে-এ অভিযোগে দেশটি জিটুজি প্লাস বাতিল করে। নভেম্বরের পর থেকে এ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়ার বাজার আবার কবে খুলবে তা অনিশ্চিত। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২১ এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন।

সরকারের তরফ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও উন্নত দেশগুলোর বাজার বন্ধই রয়েছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য গেছেন আট কর্মী। জাপান গেছেন ১৬৩ জন। ইতালি যেতে পারেননি একজনও। তবে একই বছর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় একাধিকবার দাবি করেছে, ১৬৫টি দেশে যাচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। ৫১টি দেশের শ্রমবাজার গবেষণা করা হয়েছে। সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির নেতৃত্বে বাজার সম্প্রসারণে নয়টি দেশও সফর করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল। কিন্তু নতুন বাজার পাওয়া যায়নি। রাশিয়া ও জাপানে বড় সংখ্যায় কর্মী পাঠানোর ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র সেশেলস প্রতিনিধি দল গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে। পর্যটন শিল্পনির্ভর দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার আগ্রহের কথা জানালেও কবে নাগাদ কর্মী পাঠানো যাবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর চাকরিজীবীদের মধ্যে এক কোটি ৭০ ছিল প্রবাসী কর্মী। যার একটি বড় অংশ ভারত, চীন ও মেক্সিকোর হলেও বাংলাদেশ স্থান করে নিতে পারেনি। সরকারি হিসাবেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়া ৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ কর্মী ছিলেন অদক্ষ। সরকারি হিসাবে ৪৩ দশমিক ২৪ শতাংশ দক্ষ কর্মী গেছেন বিদেশে। তবে এ সংখ্যাকে শুভঙ্করের ফাঁকি বলছেন জনশক্তি খাত সংশ্নিষ্ট অনেকে। তারা জানিয়েছেন, যাদের দক্ষ বলা হচ্ছে তাদের অধিকাংশ সার্টিফিকেটধারী দক্ষ।

২০১৮ সালে এক লাখ এক হাজার ৬৯৫ নারী কর্মী বিদেশ গেছেন। শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ৭৩ হাজার ৭১৩ জন। দেশটিতে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ছিল গত বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ২০১৮ সালে সৌদি আরব থেকে এক হাজার ২৩৪ জন নারী ফিরেছেন নির্যাতিত হয়ে। নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেছেন, নারীদের উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসনের সুযোগ থাকলে তারা মধ্যপ্রাচ্যে যেতেন না।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বদরুল আরেফীন (শ্রমবাজার গবেষণা) জানান, কোন দেশে কত সংখ্যক কর্মীর চাহিদা রয়েছে, কীভাবে সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়- মন্ত্রণালয় সেই চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টা মন্ত্রণালয়ের সবসময়ই রয়েছে।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা সভাপতি বেনজির আহমেদ এমপি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করছেন, তা রফতানিকারকদের সৃষ্টি করা বাজার। তারা দেশে দেশে ঘুরে চাহিদাপত্র আনেন। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে কর্মী পাঠাতে হয়। শ্রম কূটনীতি শুরু হয়েছে পরিবর্তিত বিশ্বে। তাই এ দায়িত্ব মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।

Pin It