মুক্তিযোদ্ধারা কখনো হারিয়ে যায় না

kidz-story-26320-01

মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা শুনতে শাহানের খুব ভালো লাগে। শাহানের দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ না করলেও তাদের খিলগাঁওয়ের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মিনি ক্যাম্প।

এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতেন। বেতারে প্রচারিত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খবরেও এই বাড়িটির কথা তখন বলা হতো। শাহানের দাদী প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়াতেন। দাদার কাছ থেকে শাহান মুক্তিযুদ্ধের এসব কথা শুনেছে।

একদিন মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনার সময় শাহান দাদাকে জিজ্ঞেস করলো ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘স্বাধীনতা’ মানে কী? দাদা বললেন, এরা খুবই কাছাকাছি। দুই ভাইয়ের মতো। মুক্তিযুদ্ধ মানে মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ। পরাধীনতা থেকে শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার জন্য যে যুদ্ধ। আবার স্বাধীনতা মানে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা, মুক্তভাবে বেঁচে থাকার অধিকার।

দাদা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কথা স্মরণ করে শাহানকে বললেন, শোনোনি! বঙ্গবন্ধু বলেছেন,  ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শাহানের দাদা তার বাবা-মা ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকাতেই থাকতেন। শাহানের মেজো কাকার বয়স তখন মাত্র তিন মাস। পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার সময় ছোট্ট শিশুকে নিয়ে প্রায়ই ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকতেন তারা। পরে সৈন্যরা চলে গেলে আবার বেরিয়ে আসতেন।

শাহানের দাদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন বাবা-মাকে দেখতে তিনি তাদের আরেক বাড়ি শনির আখড়ায় যান। আগের দিন রাতে ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি অপারেশন চালায়। সেই অপারেশনে শাহানের দাদার ছোট ভাই, অর্থাৎ শাহানের ছোট দাদা অংশ নিয়েছিলেন। ওই ঘটনার জন্য পাকিস্তানি মিলিটারিরা মুক্তিযোদ্ধাদের হন্যে হয়ে খুঁজছিল।

শাহানের দাদাকে দেখতে পেয়ে ডেকে পাঠানো হয়। বাড়ির সবাই তখন সেকি কান্না! আর্মির কাছে গেলে কেউ কি ফিরে আসে? মজার বিষয় হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির কথা শুনে তারা দাদাকে ছেড়ে দেয়। দাদার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জানতে চেয়েছিল সৈন্যরা। দাদা বলেননি। কোনমতে কাটিয়ে এসেছেন। সৈন্যরা তাকে এলাকা না ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। বাবা-মা, আত্মীয়দের কথা ভেবে দাদা কিছুদিন সেখানে ছিলেন। তবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে তার ঠিকই সাক্ষাৎ হতো।

২৫ মার্চ রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও হামলা করে তারা। গুলির শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। চারদিকে হৈ চৈ, ছুটোছুটি শুরু হয়। বেশকিছু গুলি শাহানের দাদুর বাসার চালের টিনে এসে পড়ে। ভয়ে সবাই খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েন তারা। উৎকণ্ঠায় রাত কাটে সবার। পরদিন শাহানের এক কাকা অনেকগুলো তামাটে গুলির খোসা এনে দাদার কাছে দেন। সেই গুলির কিছু খোসা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে দাদা এখনো রেখে দিয়েছেন।

২৫ মার্চের আরেকটি ঘটনা শাহানকে বলেন দাদা। শাহানের দাদার বড় ভাই অর্থাৎ, শাহানের বড় দাদা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে উৎসাহ দিতেন। তিনি ছিলেন অনেক নাম করা ব্যবসায়ী। ঢাকার শান্তিনগরে তার তেলের ব্যবসা ছিল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তার তেলের দোকানগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে সব দোকান। তাকে খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা।

তার মালিবাগের বাড়িতে ছিল রিকশার গ্যারেজ। প্রায় ৩০টির মতো রিকশা ছিল সেখানে। তিনি যখন বুঝতে পারলেন এই রিকশাগুলোও পুড়িয়ে দেয়া হতে পারে, তখন ছোট ভাই অর্থাৎ, শাহানের দাদার খিলগাঁওয়ের বাড়িতে সেগুলো নিয়ে রাখা হয়। রিকশাচালকরাও মালিবাগ থেকে খিলগাঁওয়ে চলে যান। এই রিকশাচালকরাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তারাই মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় খিলগাঁও ও আশপাশের এলাকায় অপারেশন চালাতেন।

বেশ কয়েক বছর আগে শাহানদের এই বাড়িতে একটি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে দাদার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। শাহান তখন ছোট। কিছু বোঝেনি। এখন কিছুটা বড় হয়েছে সে। যুদ্ধদিনের কথা শুনতে খুব ভালো লাগে তার। শাহানের ছোট দাদা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার কাছ থেকেও শাহান মাঝে-মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনে।

বড় দাদা মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। এখন বেঁচে আছেন দুজন। শাহানের দাদা ও ছোট দাদা। তাদেরও বয়স হয়েছে। প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। এক সময় তারা যখন থাকবেন না, তখন আর মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনা হবে না, ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায় শাহানের। তাদের নিয়ে ইতিহাস লেখা হবে বইয়ের পাতায়। তাতে অনেক ঘটনাই হয়তো উঠে আসবে না। হয়তো মুক্তিযুদ্ধে শাহানের কোনো দাদার অবদানের কথা লিপিবদ্ধ থাকবে না। তাতে কি!

শাহান ভাবে, তার দাদাদের মতো শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা উঠলে শাহান গর্ব করেই বলে আমার দাদারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।

Pin It