নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান, নিশ্চয়ই দলের জন্য বড় প্রাপ্তি। দিন শেষে সঙ্গী তবু হারের যন্ত্রণা। প্রতিপক্ষের স্কোর যে ছিল আরও অনেক উঁচুতে! লড়াই হলো, খানিকটা সম্ভাবনাও জাগল। কিন্তু জয়ের তৃপ্তি মিলল না। নিজেদের রেকর্ড রান তুলেও হারল বাংলাদেশ।
ট্রেন্ট ব্রিজের উইকেট ছিল ব্যাটিং স্বর্গ। তাতে রান উৎসবে মেতে উঠল দুই দলই। তবে অস্ট্রেলিয়ার উৎসব হলো বেশি রঙিন। বাংলাদেশ তাই থমকে গেল ৪৮ রান পেছনে।
নটিংহ্যামে বৃহস্পতিবার ১৪৭ বলে ১৬৬ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস উপহার দেন ডেভিড ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে তোলে ৩৮১ রান। মুশফিকুর রহিমের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ যেতে পেরেছে ৩৩৩ পর্যন্ত।
পরাজয়ের ব্যবধান যদিও সুস্পষ্ট, খুব বেশি লড়াইয়ের ছাপ শেষের ফলে হয়তো নেই। তবে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর লড়াইয়ে বাংলাদেশ জিইয়ে রেখেছিল আশা। প্রয়োজনীয় রান রেট যদিও বাড়ছিল ক্রমে, তবে এই দুজন ছিলেন বলে সম্ভাবনাও ছিল। ৪৬তম ওভারে মাহমুদউল্লাহ ও সাব্বির রহমান পরপর দুই বলে বিদায় নিলে শেষ হয়ে যায় সামান্য সম্ভাবনাটুকুও।এই দুজন জুটি বাঁধার আগ পর্যন্ত অবশ্য আশার আলো মিলিয়ে আসছিল ক্রমেই। এত বড় রান তাড়ায় সবচেয়ে জরুরি ছিল সৌম্য সরকারের ব্যাটে ঝড়ো শুরু। ম্যাচের প্রথম ভাগে দারুণ বোলিং করে তার আত্মবিশ্বাসও থাকার কথা তুঙ্গে। কিন্তু চতুর্থ ওভারেই রান আউট হয়ে যান বাঁহাতি ওপেনার।
সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনে নামা সাকিব আল হাসান। তামিম ইকবাল বরাবরের মতোই ছিলেন ইনিংস ধরে রাখার ভূমিকায়। খুব আগ্রাসী না হলেও গড়ে ওঠে জুটি।
সেখানে ছন্দপতন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিবের বিদায়ে। বিশ্বকাপে টানা চতুর্থ পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের পর এবার ৪১ বলে ৪১ করে ফিরেছেন মার্কাস স্টয়নিসের স্লোয়ারে।
তামিম ৬৫ বলে স্পর্শ করেন টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ফিফটি। যখন প্রয়োজন ছিল ওয়ার্নারের মতো লম্বা ইনিংস, ৬২ রানে মিচেল স্টার্কের বাইরের বল টেনে আনলেন তিনি স্টাম্পে।
প্রথম বলে স্টার্কের বাউন্সার হেলমেটে লাগার পরও লিটন দাস বেশ সাহসী শুরু করেছিলেন। অ্যাডাম জ্যাম্পার দারুণ ডেলিভারি তাকে থামায় ২০ রানে।এরপর মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ চেষ্টা করেছেন, খেলা যতটা গভীরে টেনে নেওয়া যায়। এক-দুই রানে জুটি গড়ে তুলেছেন। পরে তুলেছেন ঝড়। বিশেষ করে মাহমুদউল্লাহ যতক্ষণ ছিলেন, মনে হচ্ছিল অসম্ভব না জয়। ৯৫ ও ৯১ মিটার লম্বা দুটি ছক্কা মেরেছেন জ্যাম্পাকে, প্যাট কামিন্সকে পাঠিয়েছেন গ্যালারিতে।
৫০ বলে ৬৯ রানের ইনিংসটি শেষ হয়েছে ন্যাথান কোল্টার-নাইলকে ছক্কা মারতে গিয়ে। শেষ দিকে ঝড় তোলার জন্যই মূলত বিশ্বকাপ দলে যায় জায়গা হয়েছে, সেই সাব্বির প্রথম সুযোগে প্রথম বলেই আউট বাইরের বল স্টাম্পে টেনে।
এরপর কেবল ছিল মুশফিকের সেঞ্চুরির অপেক্ষা। বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিটি পেয়েছেন শেষের আগের ওভারে। ইনিংস শেষে অপরাজিত ৯৭ বলে ১০২ রানে।বাংলাদেশের লক্ষ্য হয়তো এত বিশাল থাকত না, যদি ওয়ার্নারকে ফেরানোর দুটি সুযোগ কাজে লাগাতে পারতেন টুর্নামেন্টে প্রথম খেলতে নামা সাব্বির রহমান। মাশরাফি মুর্তজার বলে ১০ রানে বাঁহাতি ওপেনারের ক্যাচ নিতে পারেননি পয়েন্টে দাঁড়ানো সাব্বির। তার সামনেই পরে সুযোগ এসেছিল ওয়ার্নারকে ৭০ রানে রান আউট করার। হাতছাড়া করেন সেটিও। দুই ভুলের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে দলকে।
বাজে ছিল বোলিং-ফিল্ডিংও। সেরা বোলার ছিলেন সৌম্য, এটিই ফুটিয়ে তোলে বাকি বোলারদের চিত্র। আগের ৪৮ ওয়ানডেতে ১ উইকেট নেওয়া সৌম্য এবার নিয়েছেন ৩ উইকেট। মাঝের ওভারগুলোতে যেমন, এই ম্যাচের বাস্তবতায় স্লগ ওভারেও করেছেন দারুণ বোলিং।
এই মাঠেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪৪৪ রানের বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল ইংল্যান্ড, পরে সেটি ছাড়িয়ে ৪৮১ করেছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। উইকেটে বোলারদের জন্য কিছু ছিল না এ দিনও। তবে এমন উইকেটে নিয়ন্ত্রিত ও ধারাবাহিক বোলিং করা উচিত, সেটি করতে পারেননি বোলাররা। গত কিছুদিনে যাকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সেই রুবেল হোসেন ৯ ওভারে গুনেছেন ৮৩ রান। পাশাপাশি গোটা দলেরই গ্রাউন্ড ফিল্ডিং ছিল দৃষ্টিকটু।টস জিতলে দুই অধিনায়কেরই চাওয়া ছিল ব্যাটিং। চাওয়া পূরণ হয় ফিঞ্চের। সুযোগ কাজে লাগান তাদের ব্যাটসম্যানরা। প্রথম জুটিতে অস্ট্রেলিয়া তুলে ১২১, দ্বিতীয় জুটিতে ১৯২। বিশ্বকাপে প্রথম দুই জুটিতেই শতরান হলো তাদের এই প্রথম।
জমে ওঠার আগেই ওয়ার্নারকে ফেরানোর সুযোগ হাতছাড়া পঞ্চম ওভারে। পয়েন্টে নিচু হয়ে আসা ক্যাচ নিতে পারেননি সাব্বির। মাশরাফির বলে বার তিনেক ওয়ার্নারের ব্যাটের কানায় লেগেও স্টাম্পে যায়নি বল। এছাড়া আর কোনো সুযোগ দেয়নি অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার। জুটির শতরান আসে ৯৯ বলে।
মূল বোলাররা যখন কোনো ছাপই রাখতে পারছেন না, সৌম্যর হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক। টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ওভারে সৌম্যই দলকে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত ব্রেক থ্রু। একটু বাড়তি লাফানো বলে ফিঞ্চ আউট হন ৫১ বলে ৫৩ করে।
সেই উইকেট কাজে লাগিয়ে মোমেন্টাম নিজেদের পক্ষে আনতে পারেনি বাংলাদেশ। ওয়ার্নার ও খাওয়াজা অনায়াসেই গড়ে ফেলেন আরেকটি জুটি। বাংলাদেশের বোলিং ছিল না ধারাবাহিক। এই দুজনকে তাই নিতে হয়নি তেমন কোনো ঝুঁকি।১১০ বলে ওয়ার্নার স্পর্শ করেন তার ষোড়শ ওয়ানডে সেঞ্চুরি, এই বিশ্বকাপে দ্বিতীয়। সেঞ্চুরির পর খেলতে থাকেন ওয়ার্নারসুলভ আগ্রাসী সব শট। বাড়তে থাকে রানের গতি। সেঞ্চুরি থেকে দেড়শতে যেতে লাগে কেবল ২৯ বল।
বিশ্বকাপে একাধিকবার দেড়শ ছোঁয়ার কীর্তি ওয়ার্নারই গড়লেন প্রথম। গত বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে করেছিলেন ১৭৮।
জুটির রান যখন দুইশর কাছে, সৌম্য আবার দলকে এনে দেন খানিকটা স্বস্তির উপলক্ষ্য। ১৪ চার ও ৫ ছক্কায় ১৬৬ করে ওয়ার্নার ফেরেন আপার কাট করতে গিয়ে। এরপর ১০ বলে ৩২ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে যান ম্যাক্সওয়েল। ৭২ বলে ৮৯ রান করা খাওয়াজাকে ফেরান সৌম্য। শেষ ১০ ওভারে অস্ট্রেলিয়া তোলে ১৩১ রান।
ওয়ানডেতে কখনোই ৩৩০ রানের বেশি করতে পারেনি যে দল, ৩৮২ তাদের জন্য ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরেই। তবু চেষ্টা করেছে দল। ৩৫ ওভার শেষে দুই দলেরই রান ছিল সমান। কিন্তু বাংলাদেশের কেউ হতে পারেননি ওয়ার্নার-ম্যাক্সওয়েল, বোলিং আক্রমণেও ছিল না কোনো কোল্টার-নাইল বা স্টার্ক!সংক্ষিপ্ত স্কোর:
অস্ট্রেলিয়া: ৫০ ওভারে ৩৮১/৫ (ফিঞ্চ ৫৩, ওয়ার্নার ১৬৬, খাওয়াজা ৮৯, ম্যাক্সওয়েল ৩২, স্টয়নিস ১৭*, স্মিথ ১, কেয়ারি ১১*; মাশরাফি ৮-০-৫৬-০, মুস্তাফিজ ৯-০-৬৯-১, সাকিব ৬-০-৫০-০, রুবেল ৯-০-৮৩-০, মিরাজ ১০-০-৫৯-০, সৌম্য ৮-০-৫৮-৩)।
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩৩৩/৮ (তামিম ৬২, সৌম্য ১০, সাকিব ৪১, মুশফিক ১০২*, লিটন ২০, মাহমুদউল্লাহ ৬৯, সাব্বির ০, মিরাজ ৬, মাশরাফি ৬; স্টার্ক ১০-০-৫৫-২, কামিন্স ১০-০-৬৫-০, ম্যাক্সওয়েল ৩-০-২৫-০, কোল্টার-নাইল ১০-০-৫৮-২, স্টয়নিস ৮-০-৫৪-২, জ্যাম্পা ৯-০-৬৮-১)।
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৪৮ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: ডেভিড ওয়ার্নার
